সম্প্রতি, ১৬ জুন ২০২৫ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবারও ভারতের জন্য লেভেল-২ ট্রাভেল অ্যাডভাইসরি (US Travel Advisory) কার্যকর করলো, যেখানে মার্কিন নাগরিকদেরকে বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে ভারতে ভ্রমণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এই অ্যাডভাইসরিতে ভারত জুড়ে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকির কথা তুলে ধরা হয়েছে—যার মধ্যে সহিংস অপরাধ থেকে শুরু করে সন্ত্রাসবাদ পর্যন্ত সবকিছুর কথাই উল্লেখ করা হয়েছে।
এই নির্দেশিকায় ভারতের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যে জায়গাগুলিতে মার্কিন নাগরিকদের সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং আরো কিছু অঞ্চলে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
US Level-2 Travel Advisory কী?
যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভ্রমণ নিরাপত্তা সম্পর্কে চার স্তরের অ্যাডভাইসরি জারি করে থাকে:
- লেভেল ১ (নীল): সাধারণ সতর্কতা অবলম্বন করুন
- লেভেল ২ (হলুদ): অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করুন
- লেভেল ৩ (কমলা): ভ্রমণের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুন
- লেভেল ৪ (লাল): ভ্রমণ করবেন না
এই অ্যাডভাইসরি অপরাধ, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বাস্থ্য সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন ঝুঁকির ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়। লেভেল-২-এর অর্থ হলো নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় বাড়তি ঝুঁকি রয়েছে, ফলে পর্যটকদের অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে।
ভারত দীর্ঘদিন ধরেই লেভেল-২ অ্যাডভাইসরির অধীনে থাকলেও, সাম্প্রতিক আপডেটে সহিংস অপরাধ ও যৌন নির্যাতনের ঝুঁকি আরও গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি, সন্ত্রাসবাদের বিষয়টি আবার সামনে উঠে এসেছে।
কেন ভারতকে লেভেল-২ শ্রেণীতে রাখা হয়েছে?
ভারতের জন্য লেভেল-২ ট্রাভেল অ্যাডভাইসরি নতুন কিছু নয়, তবে এর পেছনের কারণগুলো সময়ের সঙ্গে বদলেছে।
অ্যালবানি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ক্ল্যারির বক্তব্য অনুযায়ী, আগে মূলত সন্ত্রাসবাদ ও বিদ্রোহ-সংক্রান্ত ঝুঁকি ছিল। তবে সাম্প্রতিক আপডেটটি মহিলাদের বিরুদ্ধে সহিংস অপরাধের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছে।
অ্যাডভাইসরিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে:
“ভারতে ধর্ষণের মতো নিন্দনীয় অপরাধ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সহিংস অপরাধ এবং যৌন নিপীড়নেই মতো ঘটনাগুলি পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে ক্রমবর্ধমান হারে ঘটে চলেছে।”
এছাড়াও সতর্ক করা হয়েছে যে, সন্ত্রাসী হামলা যেকোনো সময়, পূর্বসতর্কতা ছাড়াই ঘটতে পারে, বিশেষত নিম্নলিখিত অঞ্চলগুলিতে:
- পর্যটন কেন্দ্র
- পরিবহন কেন্দ্র
- সরকারি দপ্তর
- বাজার ও শপিং মল
উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলসমূহ
জম্মু ও কাশ্মীর
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা হিসাবে মার্কিন নাগরিকদের জম্মু ও কাশ্মীরে ভ্রমণ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে পূর্ব লাদাখ তথা লাদাখের রাজধানী লেহ এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে। কাশ্মীরে সন্ত্রাস ও গৃহ অস্থিরতার আশঙ্কা থাকায় অঞ্চলটিকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ নজরদারির আওতায় রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি, ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল, পাহেলগামের বৈসরান ভ্যালিতে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হয়েছিলেন—গত তিন দশকের মধ্যে এটি সবচেয়ে মারাত্মক হামলা। স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনার ছাপ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রকাশিত ট্রাভেল অ্যাডভাইসারিতে পড়েছে।
ভারত–পাকিস্তান সীমান্ত
ভারত–পাকিস্তান সীমান্ত অঞ্চলকে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ সংঘর্ষ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সীমান্তজুড়ে ভারী সামরিক মোতায়েন এবং যে কোনো সময় উত্তেজনা বাড়ার সম্ভাবনার কারণে অঞ্চলটি বিদেশি নাগরিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
শুধুমাত্র পাঞ্জাবের আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত মার্কিন নাগরিকরা যাতায়াত করতে পারেন, তবে আবশ্যিকভাবে পূর্বনির্ধারিত পাকিস্তানি ভিসা থাকতে হবে।
মণিপুর
উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্য সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।
২০২৩ সালের মে মাস থেকে শুরু হওয়া মেইতেই এবং কুকি–জো জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতিগত সংঘর্ষে ২৫০ জনেরও বেশি নিহত, ৬০,০০০ এর বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত, এবং বহু বাড়ি ও ধর্মীয় স্থান ধ্বংস হয়েছে। পরিস্থিতি এখনও সম্পূর্ণভাবে স্থিতিশীল নয়।
যে রাজ্যগুলোতে অনুমতি ছাড়া মার্কিন কর্মকর্তা যেতে পারবেন না
যুক্তরাষ্ট্র সরকার বলেছে, পূর্ব মহারাষ্ট্র, উত্তর তেলেঙ্গানা ও পশ্চিম বাংলার কিছু অংশে যেতে হলে আগে অনুমতি নিতে হবে। এই এলাকাগুলোতে দীর্ঘদিন ধরেই নকশালপন্থী হিংসা ও বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড চলছে, যা বিদেশি নাগরিকদের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে।
এছাড়াও বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, ওড়িশা ও মেঘালয় রাজ্যগুলোতেও অনুমতি ছাড়া মার্কিন কর্মকর্তাদের যাওয়া নিষেধ।
উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্য নিয়ে সতর্কতা
অ্যাডভাইসরিতে অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম, নাগাল্যান্ড, অসম, মিজোরাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা-র নামও রয়েছে। এই রাজ্যগুলোতে ভ্রমণের উপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা নেই, তবে এই রাজ্যগুলির রাজধানী ছাড়া অন্য এলাকায় যেতে মার্কিন নাগরিকদের বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে, বা এক কথায় নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
যদিও জায়গাগুলি বর্তমানে যথেষ্ট শান্তিপূর্ণ, তবে অতীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা যেমন, বোমা বিস্ফোরণ, পরিবহন কাঠামোতে হামলা ইত্যাদি কারণে এগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হচ্ছে।
সীমান্ত ও আইনি সতর্কতা
ভারত-নেপাল সীমান্ত স্থলপথে পারাপার নিয়েও সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ভিসা সংক্রান্ত ভুল বোঝাবুঝির কারণে অতীতে অনেক মার্কিন নাগরিক এই স্থলপথের বর্ডারে জরিমানা ও আটক হওয়ার মতো ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে।
জানানো হয়েছে, ইলেকট্রনিক ভিসা (e-Visa) সীমান্তে গ্রহণযোগ্য নয়, এবং প্রিন্টেড ভিসা থাকা সত্ত্বেও অনেকে আইনি জটিলতায় পড়েছেন।
ট্রাভেল অ্যাডভাইসারি তে উল্লেখ করা হয়েছে, স্যাটেলাইট ফোন ও GPS ডিভাইস ভারতে নিষিদ্ধ। এ ধরনের ডিভাইস বহন করলে $200,000 পর্যন্ত জরিমানা অথবা তিন বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
একাকী মহিলা পর্যটকদের জন্য বিশেষ সতর্কতা
এই অ্যাডভাইসরির অন্যতম প্রধান বার্তা হলো, নারী পর্যটকরা যেন একা ভ্রমণ না করেন, বিশেষ করে রাতে।
আক্ষরিক অর্থে ভারত একটি সংস্কৃতিময় ও বৈচিত্র্যে ভরা দেশ হলেও, অনেক পর্যটনস্থলে উত্ত্যক্ততা ও শারীরিক হেনস্থার ঘটনা ঘটেছে।
মার্কিন সরকার বলেছে, পর্যটকরা যেন:
- জনপ্রিয় ও রিভিউ-ভিত্তিক হোটেলে থাকেন
- নির্জন স্থান এড়িয়ে চলেন
- নিয়মিত পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন
গ্রামীণ বা বিচ্ছিন্ন এলাকায় মার্কিন কনস্যুলেটের উপস্থিতি সীমিত, সেই কারণে এসব অঞ্চলে জরুরি সহায়তা প্রদান করা কঠিন হতে পারে।
ভারতের কোন অঞ্চলগুলো নিরাপদ? (US Travel Advisory)
যা দেখা যাচ্ছে, মার্কিন সরকারের ভ্রমণ নির্দেশিকায় ভারতের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের জন্য সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে, বিশেষত উত্তর ও পূর্ব ভারত এবং মধ্য ভারতের কিছু অংশ; উল্লেখ্য এইসব অঞ্চলের ব্যতিরেকে, ভারতের বহু অঞ্চল এখনো আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য নিরাপদ ও জনপ্রিয়। বিশেষ করে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারত নিরাপদ হিসাবে বিবেচিত হয় এবং প্রতিবছর লক্ষাধিক বিদেশি পর্যটক এখানে ভ্রমণ করেন।
পশ্চিম ভারতের রাজস্থান, গুজরাট ও মহারাষ্ট্র যথেষ্ট নিরাপদ রাজ্যগুলির মধ্যে অন্ত্যতম। জয়পুর, উদয়পুর, আহমেদাবাদ, মুম্বই—সব শহরেই বিদেশি পর্যটকরা নির্বিঘ্নে ভ্রমণ করেন।
দক্ষিণ ভারতে, বেঙ্গালুরু (কর্নাটক) একটি আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি শহর, কাছেই কুর্গ ও চিকমাগলুর পাহাড়ি গন্তব্য। তামিলনাড়ুর নীলগিরি অঞ্চলের উটি, কুনুর ও কোদাইকানাল অত্যন্ত নিরাপদ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর।
কেরালাও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য স্বর্গরাজ্য—মুন্নার, আলেপ্পি, ওয়েনাড, কোভালাম, পূবার আইল্যান্ড, ও থেক্কাডি বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
গোয়া ও পুদুচেরি বিদেশিদের বিশেষ পছন্দের জায়গা। গোয়ার আরামবোল, পালোলেম, মোরজিম, আগোন্ডা, ও কালাঙ্গুটের পাশাপাশি, পুদুচেরির অরোভিলে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের সর্বাধিক পছন্দের তালিকায়।
আর বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, এই জায়গাটিও বিদেশিদের খুব পছন্দের জায়গা , বিশেষত হ্যাভলক ও নীল আইল্যান্ডস।
উত্তর ভারতের লাদাখ, হিমাচল প্রদেশ, ও উত্তরাখণ্ড—সবই অ্যাডভাইসরিতে নিরাপদ জায়গা হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে। সুতরাং হিমালয়ের ওপর সৌন্দর্য উপভোগ করার ক্ষেত্রেও মার্কিন নাগরিকদের কোনো বাধা রইলো না।
এছাড়াও, পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, কালিম্পং ও কার্শিয়াং এলাকাগুলো বিদেশিদের ভ্রমণের জন্য নিরাপদ।
উপসংহার (US Travel Advisory)
ভারতের জন্য লেভেল–২ ভ্রমন নির্দেশিকা একটি জটিল বাস্তবতার প্রতিফলন। তবে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে সত্যিই সন্ত্রাস, সহিংসতা ও বিদ্রোহের ঝুঁকি থাকলেও, দেশের বেশিরভাগ অংশ এখনো বিদেশি পর্যটকদের জন্য নিরাপদ; তবে অবশ্যই নির্দেশিকা মেনে একা ভ্রমণ না করাই ভালো, বিশেষত মহিলা পর্যটকদের।
সতর্কতা অবলম্বন করলে ভারত এখনও বিশ্ব পর্যটনের মানচিত্রে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। ভারতবর্ষ পৃথিবীর কতিপয় দেশগুলির মধ্যে অন্যতম , যেখানে আপনি বরফে ঢাকা পর্বত, নীল সমুদ্র , মরুভূমি, গভীর জঙ্গলসহ সবধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন পাবেন, তেমনি ই পাবেন প্রাচীন ইতিহাস আর সংস্কৃতির ছাপ।