মেঘালয় ভ্রমণে গিয়ে অধিকাংশ পর্যটকই ঝটিকা সফর করেন প্রধানত দুটি জায়গাতে, শিলং (Shilong) আর চেরাপুঞ্জি (Cherrapunji)। অজান্তেই বাদ পরে যায় অসাধারণ কিছু জায়গা, যেখানে গেলে আপনার মন জুড়িয়ে যাবে। তেমনিই একটি জায়গার নাম মফলাং স্যাক্রেড ফরেস্ট (Mawphlang Sacred Forest)।
মফলাং – মেঘালয়ের এক offbeat গন্তব্য
মেঘালয়ের ইস্ট খাসি হিলস জেলার মফলাং স্যাক্রেড ফরেস্ট হলো খাসি জনগোষ্ঠীর শতাব্দী প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতীক। শিলং শহর থেকে খুব কাছেই অবস্থিত হলেও, এই জায়গাটি এখনও বেশিরভাগ পর্যটকের কাছে অজানা। অধিকাংশ লোকাল ট্যুর অপারেটর এই জায়গাটিকে ট্যুর প্ল্যানে রাখেনও না, কারণ এটি মূল শিলং-চেরাপুঞ্জি সড়ক থেকে কিছুটা ভিতরে অবস্থিত; বরং তারা শিলং থেকে যাত্রা শুরু করে পর্যটকদের নিয়ে সরাসরি চেরাপুঞ্জি চলে যান।

তবে আপনি যদি মেঘালয়ের সম্পূর্ণ একটি ট্যুর পরিকল্পনা করেন, অর্থাৎ যদি আপনি গতানুগতিক টুরিস্ট স্পট গুলির বাইরে বেরিয়ে মেঘালয়ের নির্ভেজাল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে চান, তাহলে মাওফ্লাং সেক্রেড ফরেস্ট অবশ্যই আপনার ভ্রমণ তালিকায় রাখুন। এই রহস্যে মোড়া অরণ্যে আপনি দেখতে পাবেন দুর্লভ উদ্ভিদ, প্রাচীন বৃক্ষ, এবং ইতিহাসের নিঃশব্দ উপস্থিতি; আর উপভোগ করতে পারবেন মন ভালো করে দেওয়া এক সবুজ উপত্যকা।
আসুন, আরো একটু বিস্তারিতভাবে জেনে নিন মাফলাং স্যাক্রেড ফরেস্টের খুঁটিনাটি।
মফলাং কোথায় অবস্থিত?
একটি সংক্ষিপ্ত ভৌগোলিক পরিচিতি জেনে রাখা ভালো।
মফলাং গ্রামটি মেঘালয়ের ইস্ট খাসি হিলস জেলায় অবস্থিত, শিলং থেকে প্রায় ২৭ কিমি এবং চেরাপুঞ্জি থেকে ৪৭ কিমি দূরে। সেক্রেড ফরেস্টটি শিলং-চেরাপুঞ্জি জাতীয় সড়ক (NH-6) থেকে ১১ কিমি ভিতরে, যার জন্য কিছুটা অফ-রোড ভ্রমণ করতে হয়।
সম্পর্কিত প্রতিবেদন: চেরাপুঞ্জির সেরা ৯টি দর্শনীয় স্থান
মফলাং স্যাক্রেড ফরেস্টের ইতিহাস
মাওফ্লাংকে প্রাচীন খাসি সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ধরা হয়।
“মাওফ্লাং” নামটি এসেছে দুটি শব্দ থেকে – “মাও” মানে পাথর এবং “ফ্লাং” মানে ঘাস।
স্থানীয় লোককথা অনুসারে, শত শত বছর আগে খাসি উপজাতিরা এই জঙ্গলের একটি বড় পাথরের সামনে প্রার্থনা করতেন এবং পশুবলি দিতেন। সেই থেকেই এটি একটি পবিত্র স্থান হিসেবে সংরক্ষিত আছে।
মফলাং (Mawphlang) ভ্রমণের বৃত্যান্ত
আপনি হয়তো এর আগে অনেক পাহাড়ি গন্তব্যে ভ্রমণ করেছেন,, কিন্তু মেঘালয়ের সবুজ পাহাড়ি ভূমির সৌন্দর্য একেবারেই আলাদা।
শিলং-চেরাপুঞ্জি জাতীয় সড়ক (NH 6) ছেড়ে শিলং-মওসিনরাম রাস্তা (NH-106) ধরার পর থেকেই রাস্তার দুধারে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চোখে পড়ে।
মফলাং (Mawphlang) পৌঁছে আগে উপভোগ করুন উপত্যকার সৌন্দর্য…
যখন আপনি মাওফ্লাং ট্যুরিস্ট পয়েন্টে পৌঁছাবেন, তখন প্রথমেই আপনি দেখতে পাবেন একটি বিশাল সবুজ উপত্যকা। এখানে নরম রোডের নিচে নরম ঘাসের কার্পেটে বসে উপভোগ করুন উপক্যকার সৌন্দর্য , মেঘেদের আনাগোনা , আর হিমেল হাওয়ার অনুভূতি।
উপত্যকার মাঝখানে একটি পিচ রাস্তা চলে গেছে। রাস্তা দুপাশে গজিয়ে উঠেছে নাম না জানা ছোট ছোট গাছ , জংলী অথচ বাহারি ফুলে ভর্তি। যারা গাছপালা ভালোবাসেন, তাদের জন্য এটি এক স্বর্গরাজ্য।
রাস্তাটির অন্যপাশে একটি ছোট মূর্তি ও একটি প্রাচীন স্টেডিয়াম রয়েছে। এটি ফটোগ্রাফির জন্য চমৎকার একটি জায়গা।

মফলাং স্যাক্রেড ফরেস্টে প্রবেশ
উপত্যকার সৌন্দর্য উপভোগ করার পর আপনি প্রবেশ করুন মফলাং-এর পবিত্র অরণ্যে। প্রবেশপথের কাছে রয়েছে তিনটি সাজানো পাথর ও একটি পাথরের বেঞ্চ—ছবি তোলার জন্য উপযুক্ত স্থান।
অরণ্যে প্রবেশের জন্য একজন গাইড ভাড়া নিন।
কেন গাইড নেয়া জরুরি?
- অরণ্যের ভেতরে পথ হারানোর আশঙ্কা থাকে।
- অনেক সময় গাইড ছাড়া আপনাকে ঢুকতেই দেয় না – এটা তাদের জীবিকা।
- গাইডরা বনভূমির গল্প ও উদ্ভিদ সম্পর্কিত তথ্য জানান।
- গাইডরা দলগত ছবি (group photo) তুলতেও সাহায্য করেন।
গাইড চার্জ ছোট ও বড় group অনুযায়ী ভিন্ন। সাধারণত ৫ জনের দলের জন্য গড়ে মাথাপিছু ₹১০০।
অরণ্যে অভিজ্ঞতা
ভেতরে প্রবেশ করতেই এক দারুন পরিবেশে আপনি নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন। প্রথমে ঘন মনে না হলেও, ভিতরে ঢুকতেই বিশাল বিশাল প্রাচীন গাছের দল আপনাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলবে।
দুর্লভ উদ্ভিদের আধিক্য থাকায় মফলাং স্যাক্রেড ফরেস্ট উদ্ভিদবিজ্ঞানের গবেষক বা শিক্ষার্থীদের জন্য এক দুর্দান্ত জায়গা।

আমি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়েছিলাম একটি Yew Tree (ট্যাক্সাস) দেখতে পেয়ে!
এই গাছের ছাল থেকে পাওয়া যায় Taxol – একটি শক্তিশালী ক্যান্সার প্রতিরোধক ঔষধ। ট্যাক্সল ওভারিয়ান, ব্রেস্ট, প্রোস্টেট, ফুসফুস, জরায়ু এবং অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এই জঙ্গলে যে এই মহৌষধি গাছকে দেখা যাবে তা আমি আশা করিনি।
বনের গভীরে রয়েছে প্রাচীন বলির স্থান ও পাথরের দেবতার চিহ্ন – এক রহস্যময় অভিজ্ঞতা।
প্রায় ৪০-৪৫ মিনিটের জঙ্গল ট্রেক শেষে আপনি ফিরে আসবেন এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা নিয়ে। এখানকার গাইডরা খুবই friendly এবং ইংরেজিতে সাবলীল, আপনাকে সুন্দর করে সব কিছু বুঝিয়ে দেবে।

বিশেষ সতর্কতা – “কিছু নিয়ে যাবেন না”
স্থানীয় গাইডরা বনের ভেতর কিছু তুলতে বা নিয়ে যেতে নিষেধ করেন।
একদিকে এটি স্থানীয় বিশ্বাস – কিছু নিলে অমঙ্গল ডেকে আনবে।
অন্যদিকে, বিজ্ঞান বলছে – এখানে অনেক অজানা উদ্ভিদ আছে, যার কোনটা বিষাক্ত আর কোনটা নিরাপদ বলা মুশকিল। তাই প্রকৃতিকে উপভোগ করুন, না ছুঁয়ে।
আরো পড়ুন: গার্ডেন অফ কেভস – মেঘালয়ের এক অজানা রত্ন
মফলাং-এ কি খাবার পাবেন ?
আপনার যদি খিদে পেয়ে যায়, তবে মফলাং উপত্যাকার পাশে ২-৩ টি ছোট ছোট স্টল আছে – টিফিন বা লাঞ্চ পাওয়া যায়।
মেনু সীমিতঃ
- ভাত-মুরগি/ডিম
- নুডলস
- শুকনো স্ন্যাকস (চিপস, বাদাম ইত্যাদি)
তবে খাবারের স্বাদ খুব ভালো নাও লাগতে পারে; বিশেষত বাঙালিদের পছন্দ না হওয়ারই কথা। খাসি জাতির মানুষদের রান্না বান্না একটু সিদ্ধ-সিদ্ধ আর ঝাল মসলা ছাড়া। তাই সাথে খাবার নিয়ে যাওয়াই ভালো।
কিভাবে মফলাং পৌঁছাবেন (Mawphlang)?
সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায় – শিলং থেকে গাড়ি ভাড়া করুন, প্রায় ২৭ কিমি পথ, ১ ঘণ্টার ভ্রমণ। শিলং-চেরাপুঞ্জি জাতীয় সড়ক (NH 6) আপনাকে ছেড়ে শিলং-মওসিনরাম রাস্তা (NH-106) ধরে প্রায় ১১ কিমি ভিতরে যেতে হবে।
ঘোরাঘুরির জন্য ২-৩ ঘণ্টা যথেষ্ট।
টিপস: শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি যাওয়ার পথে মাওফ্লাং ঘুরে নিন।
নিকটতম বিমানবন্দর:
- উমরই এয়ারপোর্ট (শিলং)
- লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদলৈ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (গুয়াহাটি)
আরো পড়ুন: শিলং-এর ১৯টি সেরা দর্শনীয় স্থান
মফলাং সফরের সেরা সময়:
মেঘালয়ে বৃষ্টি বছরজুড়ে থাকে। যদিও বর্ষায় (জুন-সেপ্টেম্বর) সবুজে ভরে যায়, কিন্তু ভ্রমণ ব্যাহত হতে পারে।
সেরা সময় (Best time to visit Mawphlang):
সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে মে মাস, বিশেষ করে নভেম্বর থেকে এপ্রিল।
সম্পর্কিত প্রতিবেদন: ডাওকি
মফলাং (Mawphlang) সফরের জন্য কোথায় থাকবেন?
সবচেয়ে ভালো – শিলং–এ রাত কাটানো, যেখান থেকে আপনি সহজেই মাওফ্লাং পৌঁছাতে পারেন।
হোটেল, রিসোর্ট ও হোমস্টে – সবই পাবেন।
অন্যথায়, চেরাপুঞ্জি-তেও থাকতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে চেরাপুঞ্জি থেকে শিলং ফেরার পথে মাওফ্লাং ভ্রমণ করুন।
শেষ কথা (Final Remarks)
মাওফ্লাং সেক্রেড ফরেস্ট মেঘালয়ের এক ভিন্নস্বাদের গন্তব্য – পুরোপুরি কমার্শিয়াল টুরিস্ট স্পট নয় , সেকারণে মানুষের ভিড় কম , প্রকৃতিকে অনুভব করার সুযোগ বেশি।
ঘন বন, দুর্লভ উদ্ভিদ এবং ঐতিহাসিক পটভূমি – সব মিলিয়ে প্রকৃত প্রেমীদের জন্য এক আদর্শ জায়গা। অবশ্যই ঘুরে আসুন শিলং টুর (Shillong tour) করার সময়।
Read in English: Mawphlang Sacred Forest