বিশ্বকবির শান্তিনিকেতন (Santiniketan) বর্তমানে এক অত্যন্ত জনপ্রিয় এক ভ্রমণ গন্তব্য। অতি উন্নয়নের জোয়ারে শেষ বারো-চোদ্দ বছরে প্রকৃতির বুক চিড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য হোটেল, সোনাঝুরির নস্টালজিক রাঙামাটির রাস্তা হয়েছে শহুরে কালো পিচে ঢাকা!! প্রায় প্রতি উইকএন্ডেই সোনাঝুরির হাট থাকে জমজমাট, আর সপ্তাহান্তে দিন তিনেকের ছুটি পেলে তো কথাই নেই, হোটেলগুলোয় ঠাঁই মেলা ভার। তবে আপনি যদি এক প্রকৃত ভ্রমণপ্রেমী হন, মনে রাখবেন, কবিগুরুর আবাসভূমি কেবলমাত্র একটি বকলমে পর্যটনকেন্দ্র নয়—এটি বাঙালির চিরন্তন আবেগ, বাংলার সংস্কৃতি, শিক্ষা, ও ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রতীক।
নোবেল বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করা এই ছোট্ট গ্রাম্য-শহরটি শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও প্রকৃতিকে একসুরে বেঁধে দিয়েছে এক অনন্য পন্থায়। আপনি যদি প্রথমবার শান্তিনিকেতন ভ্রমণে আসেন, অথবা আগেও এসেছেন এবং আবারও সেই নস্টালজিক স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করে প্রকৃত শান্তিনিকেতনকে উপলব্ধি করতে চান, তাহলে এবারটা ঘুরে দেখুন একটু অন্যভাবে, সঠিক ভ্রমণ পরিকল্পনা সাথে নিয়ে (Santiniketan Tour Plan), আর একই সাথে চিরস্মরণীয় করে রাখুন শান্তিনিকেতন ভ্রমণের দিন কটা।
এই বিস্তারিত শান্তিনিকেতন ট্যুর প্ল্যান (Santiniketan Travel Guide) প্রস্তুত করেছেন দুই প্রাক্তন শান্তিনিকেতনী (Dr. SD & Ms. SMD) যাঁরা এখানে প্রায় ২০ বছর ধরে পড়াশুনা ও বসবাস করেছেন। এখানে থাকছে একটি পূর্ণ ৩ দিনের ভ্রমণসূচি, যাতায়াত ব্যবস্থা, ভ্রমণের সঠিক সময়, থাকার জায়গা, খাওয়ার ব্যবস্থা এবং বিশেষ কিছু ভ্রমণ টিপস। ভ্রমণ সংক্রান্ত বিষয়ের বাইরে সবশেষে থাকছে বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কিছু তথ্য।
Table of Contents
শান্তিনিকেতন: সংক্ষিপ্ত পরিচয়
“শান্তিনিকেতন” নামের সাথে একেবারে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এই গ্রাম্য-শহরটি এককালে ছিলো প্রকৃতির কোলে সাজানো শান্ত এক নিবাস। কোলাহলবিহীন গাছ-ঘেরা রাস্তাঘাট, মন্থর জীবনযাপন আর নিরিবিলি পরিবেশের মধ্যে ছিলো এক ভিন্ন ভ্রমণস্বাদ। সময়ের সাথে বদলেছে শান্তিনিকেতনও। তবে সেই ভিন্ন স্বাদের বেশ কিছুটা খুঁজে পাবেন আজও; শুধু ঘুরতে হবে হৃদয় থেকে, হুজুগে নয়।

সোনাঝুরির সোনালি সকাল থেকে শুরু করে বিশ্বভারতীর নস্টালজিয়া, অথবা কোপাই নদীর শান্ত ধারা থেকে শুরু করে বাউলগানের তত্ত্বকথা—শান্তিনিকেতনের প্রতিটি কোনা থেকে উদ্ভাসিত হয় জানা-অজানার গল্পকথা; সবার অজান্তে শুনিয়ে যায় শিক্ষা, সংস্কৃতি আর প্রকৃতির এক অপূর্ব মিলনগাথা, যেখানে মানুষ এক মাধ্যমমাত্র।
Related: Mousuni Island – uncover the hidden gem in South Bengal
শান্তিনিকেতনের দর্শনীয় স্থান (Tourist attractions in Santiniketan)
ফেরা যাক মূল বিষয়বস্তুতে; প্রথমেই দেখে নিন শান্তিনিকেতনে ঘুরে দেখার মতো জায়গাগুলোর তালিকাটি (Places to Visit in Santiniketan)। এই জায়গাগুলিকে আপনার শান্তিনিকেতন ট্যুর প্ল্যানে অবশ্যই রাখুন (Santiniketan Tour Plan) —
করণীয় কাজ | সংক্ষিপ্ত বিবরণ |
---|---|
বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস ট্যুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে মুক্ত আকাশের নিচে শিক্ষাব্যবস্থার নিদর্শনসহ, সেকালের স্থাপত্য, তৎকালীন বিখ্যাত শিল্পীদের ভাস্কর্য ও দেয়ালচিত্র দেখতে পাবেন। তারই সাথে দেখবেন তিনপাহাড় (মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম উপাসনা স্থল) ও কাঁচ মন্দির। |
উত্তরায়ণ ও রবীন্দ্র ভবন জাদুঘর | কবির পাঁচটি ভিন্ন বাড়ি—উদয়ন, শ্যামলী, কোনার্ক, পুনশ্চ, উদ্বিজ্জ কুটির। এখানে তাঁর ব্যবহার্য দ্রব্য, ছবি, চিঠিপত্র, পান্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। |
শ্রীনিকেতন | পর্যটকদের কাছে কম পরিচিত হলেও এটি শান্তিনিকেতনের অন্যতম অংশ। এখানে গ্রামীণ উন্নয়ন কেন্দ্র, কৃষি বিভাগ, মৃৎশিল্প, তাঁত শিল্প প্রভৃতি রয়েছে। |
সোনাঝুরি বন ও হাট | শান্তিনিকেতনের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনস্থল। শনিবারের বিশেষ আকর্ষণীয়; হাটে বাউল গান, হস্তশিল্প, ও গ্রামীণ পরিবেশ উপভোগ করতে পারবেন। তবে অন্যভাবেও সোনাঝুরিকে উপভোগ করতে পারেন। পরে আসছি সেবিষয়ে। |
কোপাই নদী | গোয়ালপাড়ার গ্রামে কোপাইনদীর ধারে বসে অলস সময় কাটানোর মধ্যে রয়েছে এক অন্য অনুভূতি। |
বল্লভপুর হরিণ উদ্যান (Deer Park) | প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য বেশ সুন্দর একটা জায়গা। এখানে সবুজ অরণ্যের মাঝে ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পাবেন সংরক্ষিত চিতল হরিণ ও দূর দূরান্ত থেকে উড়ে আসা অভিবাসী পাখি। |
প্রকৃতি ভবন | অনন্য জাদুঘর যেখানে গাছের শুকনো কাণ্ড, ডালপালা বা প্রাকৃতিক পাথর বিভিন্ন জীবজন্তু বা মানুষের রূপ নিয়েছে। |
আমার কুটির | জনপ্রিয় সমবায় সংস্থা, যেখানে পাওয়া যায় চামড়ার তৈরী জিনিসপত্র, বাটিকের বা হাতে সেলাই করা শাড়ি, ও নানান হস্তশিল্প। |
কঙ্কালিতলা মন্দির | ৫১ শক্তিপীঠের একটি, ব্রাহ্মণী নদীর ধারে অবস্থিত। |
শান্তিনিকেতনে কেনাকাটি | হাতে সেলাই নকশিকাঁথা শাড়ী, বাটিক, চামড়ার ব্যাগ, দস্তকার গহনা, হাতের তৈরি হোম ডেকর—এইসবকিছুই শান্তিনিকেতনের বা আশপাশের গ্রামের মানুষরা নিপুণভাবে তৈরী করে থাকেন; শান্তিনিকেতন স্পেশাল এইসব জিনিসপত্র আপনারা সোনাঝুরি হাট, আমার কুটির থেকে কেনাকাটি করতে পারেন। নির্ভেজাল কাঁথাস্টিচ শাড়ী কেনার জন্য তানিয়ার নকশিকাঁথা বুটিক অসাধারণ। |
Related: Joychandi Pahar – Enjoy a perfect weekend exploring the beauty of Rahr Bengal
দিনভিত্তিক শান্তিনিকেতন ভ্রমণ পরিকল্পনা
আপনার হাতে যদি শুধু একটি সপ্তাহান্ত বা কয়েকটা অবসর দিন থাকে, তাহলেই এই ভ্রমণ পরিকল্পনা অনুসরণ করে আপনি সুন্দর ও সম্পূর্ণভাবে শান্তিনিকেতন ঘুরতে পারেন —বিশ্বকবির স্মৃতি, প্রকৃতির শান্ত সৌন্দর্য, প্রাণবন্ত শিল্পসংস্কৃতি, আর গ্রামীণ আবহ, সবমিলিয়ে আপনার শান্তিনিকেতন ভ্রমণের প্রতিটি হতে চলেছে আনন্দময় আর খাঁটি বাঙালি অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ।
প্রথম দিন: আগমন ও আশেপাশে
শান্তিনিকেতনে পৌঁছানো
হোটেলে চেক-ইন
গোয়ালপাড়া / সোনাঝুরি ভ্রমণ
ট্রেন বা গাড়িতে করে বোলপুর-শান্তিনিকেতনে পৌঁছে আপনার বুক করে রাখা হোটেলে চেক-ইন করুন। বোলপুর-শান্তিনিকেতন রোডে প্রচুর হোটেল আছে; তবে যদি আপনি শান্ত পরিবেশে থাকতে চান, তাহলে সোনাঝুরি, গোয়ালপাড়া, বল্লভপুর বা প্রান্তিক এলাকায় থাকার ব্যবস্থা করুন—এই জায়গাগুলি সবুজে ঘেরা, শান্ত এবং দর্শনীয় স্থানগুলির কাছাকাছি অবস্থিত।
যদি আপনি শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস বা কবিগুরু এক্সপ্রেসে আসেন, তবে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে যাবে। দুপুরের খাবারের জন্য চমৎকার একটি জায়গা হলো রেলস্টেশনের কাছে মহামায়া হোটেল— বোলপুরের প্রাচীনতম হোটেলগুলির একটি; এখানে খুবই সাশ্রয়ী মূল্যে ঘরোয়া বাঙালি খাবার পাওয়া যায়। আর যদি একটু আগে পৌঁছান (যেমন গণদেবতা বা মা-তারা এক্সপ্রেসে) পৌঁছান, তবে হোটেলের কিচেনে বা আশেপাশের কোনো রোস্তরায় দুপুরের খাবারটা সেরে নিতে পারেন।
অপরাহ্নের ভ্রমণ
যদি সোনাঝুরির কাছাকাছি থাকেন, গাছ-ঘেরা নিরিবিলি পথ ধরে হেঁটে বেড়ান। শনিবার হলে অবশ্যই ঘুরে আসুন সোনাঝুরি হাট—এখানে খোলা আকাশের নিচে গ্রামীণ শিল্পীরা তাদের হাতে বোনা কাপড়, নকশিকাঁথা, অলঙ্কার আর ঘর সাজানোর সামগ্রী বিক্রি করেন। বাউলদের গান ভেসে আসে চারপাশে।

যদি গোয়ালপাড়ার কাছে থাকেন, বিকেলের আলো নিভে যাওয়ার আগে কোপাই নদীর তীরে হেঁটে আসুন। নদীর বালুকাবেলায় বসে এক অন্য রকম শান্তি পাবেন।
প্রান্তিকের দিকে থাকলে যেতে পারেন সায়রবিথী পার্ক; তবে এরকম পার্ক অনেক জায়গাতেই পাবেন। এর চেয়ে সোনাঝুরি বা গোয়ালপাড়া গেলে আপনি পাবেন শান্তিনিকেতনের খোয়াই বা গ্রাম বাংলার অনুভূতি।
সন্ধ্যার দিকে রতনপল্লীতে একটু ঘুরে আসতে পারেন, যেখানে রয়েছে মিশ্রিত শান্তিনিকেতনের আবহ। হালকা খাবার দাবার খেতে পারেন রতনপল্লীর ছোট ছোট রোস্তরা গুলোয়।
Related: Plan a trip to Jaldapara and explore the Indian one-horned rhinoceros
দ্বিতীয় দিন: রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ও হেরিটেজ ক্যাম্পাস
যদি আপনি শীতকালে শান্তিনিকেতন যান, তাহলে খেজুরের রস মিস করবেন না। হোটেল বা হোমস্টের কর্তৃপক্ষকে আগে থেকে বলে রাখুন ব্যবস্থা করে রাখতে। ঘরে বসে নয়, কনকনে ঠান্ডা ভোরে হন্টনপথে পৌঁছে যান গোয়ালপাড়া অঞ্চলে, ওখানেই খেজুর রস পাড়া হয় (ভোর সাড়ে ৪ টা থেকে ৫ টার মধ্যে পৌঁছান)।
- সোনাঝুরিতে প্রাতঃভ্রমণ
- রবীন্দ্র ভবন ও উত্তরায়ণ
- বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস (পাঠভবন ও কলাভবন)
- বল্লভপুর হরিণ উদ্যান
- সোনাঝুরি হাট/ গোয়ালপাড়া/সৃজনী
- নকশিকাঁথা বুটিক শপিং
সকাল: সোনাঝুরি ভ্রমণ
সকালটা শুরু করুন সোনাঝুরির সোনালি রোদে (৬টা–৯টা)। উঁচু গাছের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যালোক, ক্যানেলের শান্ত জল, খোয়াই, আর পাখির ডাক, সবমিলিয়ে সকালের সোনাঝুরি বড়ো মনোরম। চাইলে সোনাঝুরি খোয়াইয়ের পিছনে থাকা গ্রামের ভেতর ঘুরে দেখতে পারেন; এখানে এক প্রাক্তন কলাভবনের ছাত্রের ছোট্ট আর্ট শপ আছে; সেখানে একবার ঢুঁ মেরে কিছু শিল্পকর্ম কিনে নিতে পারেন।
হেরিটেজ ট্যুর

সকালের টিফিনের পর টোটো বা গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়ুন শান্তিনিকেতন হেরিটেজ ভ্রমণে। এখানে দেখার মতো জায়গাগুলি হলো—
- উত্তরায়ণ কমপ্লেক্স: উত্তরায়ণ কমপ্লেক্স: রবীন্দ্রনাথের বাসস্থান—উদয়ন, কোণার্ক, শ্যামলী। কবির হাতে লেখা পান্ডুলিপি, আলোকচিত্র, ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখতে পারবেন। (টিকেট কাটার লাইন দিতে হয়)
- উপাসনা গৃহ (কাঁচ মন্দির): উপাসনা গৃহ: স্থানীয়ভাবে “কাঁচ মন্দির” নামে পরিচিত এই প্রার্থনালয়ের দেওয়ালে বসানো রঙিন বেলজিয়ান কাঁচ রোদে ঝলমল করে ওঠে।
- বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস ট্যুর: বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস ভ্রমণ: পাঠভবনের খোলা আকাশের নিচে শিক্ষাব্যবস্থার নিদর্শন, ইউনেস্কো ঘোষিত হেরিটেজ স্থাপনা সিংহ সদন, ঘণ্টাতারা, পাঠা ভবন অফিস. শমীন্দ্র শিশু পাঠাগার, শান্ত আম্রকুঞ্জ, বকুলবীথি ও শালবীথি চত্ত্বর, তিন পাহাড় ও ছাতিমতলা—সব মিলিয়ে কবিগুরুর শিক্ষা দর্শনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি প্রত্যক্ষ করুন। (বি.দ্র.: কিছু হেরিটেজ স্থানে প্রবেশের জন্য বিশেষ অনুমতি প্রয়োজন হতে পারে।)
- কলা ভবন: শান্তিনিকেতনের চারুকলার প্রাণকেন্দ্র। এখানে দেখতে পাবেন রামকিঙ্কর বেজ, নন্দলাল বসু, যোগেন চৌধুরী, বিনোদ বিহারি মুখার্জী, কে. জি. সুব্রামানিয়ানসহ বিখ্যাত শিল্পীদের ভাস্কর্য ও দেওয়ালচিত্র। দেখতে পাবেন ব্ল্যাক হাউস—কালো টেরাকোটা আর্টে সাজানো একটি অনন্য স্থাপনা।

সময় পেলে বিকেলে শ্রীনিকেতন ঘুরে আসতে পারেন, যেখানে হস্তশিল্প ও গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্প চালু আছে।
লাঞ্চ করতে পারেন—কাশাহারা (শ্রীপল্লি), কিরণমালা (লালবাঁধ) অথবা রামশ্যাম রেস্টুরেন্টে (সোনাঝুরি)।
বল্লভপুর হরিণ উদ্যান
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর ঘুরে আসুন বল্লভপুর হরিণ উদ্যান থেকে (Deer Park)। বিস্তীর্ণ সবুজ ভূমিতে প্রাণ খুলে ঘোরার পথে প্রচুর হরিণকে দেখতে পাবেন। সন্ধ্যার আগে বিকেলের দিকে (প্রায় ৩:৩০–৪টার মধ্যে) যখন তারা লবণ চত্বরে জড়ো হয়—সে এক অসাধারণ দৃশ্য। শীতকালে গেলে ওয়াচ টাওয়ার থেকে তাকাবেন পাশের ঝিলের দিকে, দেখতে পাবেন পরিযায়ী পাখির দলকে।
অপরাহ্ন ও সান্ধ্য পরিকল্পনা
এরপর বাকি থাকবে দিনের আরো কিছুটা সময়; যদি প্রথম দিন সোনাঝুরি হাট মিস করে থাকেন, তাহলে ঘুরে আসতে পারেন ওখান থেকে। অথবা যেতে পারেন গোয়ালপাড়ায় কোপাই নদীর তীরে। বিকালের দিকে সৃজনী থেকেও ঘুরে আসতে পারেন।
আর যদি আপনি শান্তিনিকেতনের হাতে বোনা নকশিকাঁথা শাড়ীর ভক্ত হন, তাহলে ঘুরে আসুন তানিয়ার নকশিকাঁথা বুটিক থেকে। সূর্যাস্তের পরও এখানে যেতে পারেন, সন্ধ্যে সাড়ে ৭ টা বা ৮ টা অব্দি খোলা থাকে বুটিকটা। এখানে পাবেন হাতে বোনা খাঁটি পিওর সিল্কের নকশিকাঁথা শাড়ি, বাটিকের কাজ করা শাড়ী, হাতে আঁকা সিল্ক শাড়ী, স্কার্ফ, পাঞ্জাবি আর স্টোল।
👉 তানিয়ার নকশিকাঁথা বুটিক সম্পর্কিত তথ্য
খোলা থাকে: সকাল ১০টা – রাত ৮টা
তানিয়া বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী এবং ফ্যাশন টেকনোলজি গ্রাজুয়েট, নিজে হাতে তৈরী করেন শাড়ীর অসাধারণ সব ডিজাইন। এখানে শাড়ির দাম সাধারণত ৪৫০০ টাকা থেকে ১৫,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে; সিল্কের গুণমান ও কাজের সূক্ষ্মতার ওপর শাড়ীর দাম নির্ভর করে।
যোগাযোগ/হোয়াটসঅ্যাপ: 9933549474

Related: Ranchi Tour Plan – Explore Forest, Hills, Rivers, and Waterfalls Altogether
তৃতীয় দিন: প্রকৃতি, হস্তশিল্প ও বিদায়
- কঙ্কালীতলা মন্দির
- সোনাঝুরিতে প্রকৃতি ভবন
- আমার কুটির
- তানিয়ার নকশিকাঁথা বুটিক ভ্রমণ (যদি আগের সন্ধ্যায় মিস করেন)
- ফেরার পালা
আপনার শেষ দিনের শুরুটা হোক কঙ্কালীতলা মন্দির দর্শনের মাধ্যমে। এটি ৫১টি শক্তিপীঠের একটি। না, তারাপীঠের মতো হোটেলের প্রাচুর্য বা বাঁধ ভাঙা ভিড় এখানে নেই, নেই কোনো দালালের উৎপাত, নেই কোনো অসভ্যতা। বরং ব্রাহ্মণী নদীর তীরে অবস্থিত এই শক্তিপীঠের শান্ত ও আধ্যাত্মিক পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবে। ভক্তিভরে পূজা দিন এবং নিরিবিলি নদীতীরের নিরিবিলি পরিবেশ উপভোগ করুন আর একরাশ ভালোলাগা নিয়ে ফিরে আসুন।
ফিরে এসে প্রাতরাশ সেরে চলে যান সোনাঝুরির প্রকৃতি ভবনে—এটি একটি অনন্য জাদুঘর যেখানে গাছের গুঁড়ি কুকুর অথবা ঘোড়ার মতো দেখায়, পাথর যেন মানুষের প্রতিকৃতি ধারণ করে, এখানে দেখবেন সংগৃহিত নানা প্রাকৃতিক সম্পদ যেন শিল্পকর্মের রূপ ধারণ করেছে।
এরপর একই রাস্তা ধরে এগিয়ে যান বল্লভপুরের দিকে; থামুন আমার কুটিরে। এখানে একটি সমবায় সংস্থা পরিচালিত হয় যেখানে চামড়ার সামগ্রী, বাঁশের কারুশিল্প, হ্যান্ডলুম শাল এবং স্থানীয় নানান হস্তশিল্প সামগ্রী পাওয়া যায়। সমস্ত জিনিসই আশেপাশের গ্রামের মানুষরদের হাতে গড়া। আপনি ইচ্ছে করলে এখন থেকেই উপহার সামগ্রী সংগ্রহ করতে পারেন।

দুপুরের খাবারের জন্য বেছে নিতে পারেন হেঁসেল ঘর (আমার কুটির), বাঁশুরি, খড়িমাটি, মোহর কুটির বা এথেনিয়াম গ্রীনস।
যদি আগের সন্ধ্যায় তানিয়ার নকশিকাঁথা বুটিক ভ্রমণ না করে থাকেন, তবে শেষ দিনে দুপুরের খাবারের পর সময় থাকলে সেখানেও যেতে পারেন।
ফেরার জন্য ছোট্ট একটা টিপস:
সন্ধ্যার দিকে ট্রেন ধরুন—শহিদ এক্সপ্রেস বা গণদেবতা এক্সপ্রেস বুক করা ভালো হবে, যাতে আপনি শেষ দিনটা পুরো উপভোগ করতে পারেন। তবে, যদি বিদায় জানাতে মন না চায়, তাহলে আরো এক রাত থেকে পরের দিন সকালে বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ধরে বেরিয়ে পড়ুন আর ট্রেন থেকে নেমে সরাসরি অফিসে যোগ দিয়ে দিন।
Related: Kurseong Sightseeing – Best Places to visit in Kurseong
কীভাবে পৌঁছবেন শান্তিনিকেতন
শান্তিনিকেতন সহজেই রেল ও সড়ক পথে পৌঁছনো যায়।
রেলপথে: কলকাতা থেকে সবচেয়ে সুবিধাজনক ট্রেনগুলো হলো—শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস, গণদেবতা এক্সপ্রেস, মা তারা এক্সপ্রেস, শহিদ এক্সপ্রেস এবং বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার। এছাড়াও, উত্তরবঙ্গ বা উত্তর-পূর্ব ভারতগামী সব ট্রেনই (বর্ধমান-রামপুরহাট রুটে) বোলপুর-শান্তিনিকেতন স্টেশনে থামে।
সড়কপথে: ব্যক্তিগত গাড়িতে (প্রায় ৪–৫ ঘণ্টা) যাত্রা করলে সবচেয়ে সুবিধা হয়। NH2 ধরে যাত্রায় পাণ্ডবেশ্বর, ইলামবাজারের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়। অথবা আপনি বর্ধমান-গুসকরা-বোলপুর রুট হয়েও আসতে পারেন, এটি শর্টকার্ট।
ভ্রমণ টিপস: যদি আশেপাশের গ্রাম, কোপাই নদী, কঙ্কালী মায়ের মন্দির, সোনাঝুরি, বা নিরিবিলি এলাকা নিজের মতো করে ঘুরে দেখতে চান, তবে সেলফ-ড্রাইভ বা ভাড়া করা গাড়িই সেরা উপায়।
শান্তিনিকেতন ভ্রমণের সেরা সময়
শান্তিনিকেতন সারা বছরই আকর্ষণীয়, তবে ঋতুভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখা যায়—
শীতকাল (নভেম্বর–ফেব্রুয়ারি):
হিমেল হাওয়া, খোলা আকাশ আর পৌষমেলা ও জয়দেব মেলার মতো বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এটাই পর্যটনের সবচেয়ে ভিড়ের মৌসুম, বিশেষত ৭ ই পৌষ থেকে ১০ ই পৌষ। বিগত কয়েকটা বছর টালমাটাল মধ্যে পৌষমেলা বন্ধ ছিল, তবে ২০২৪ সাল থেকে আবার স্বমহিমায় চালু হয়ে গেছে।
বসন্ত (মার্চ):
বসন্ত উৎসবে (দোল/হোলি) আবির খেলা, ও সংগীত নৃত্যের তালে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে বিশ্বভারতীর প্রাঙ্গণসহ শান্তিনিকেতনের নাচ কানাচ। সকল দর্শনার্থীদের ছিল অবোধ প্রবেশাধিকার। তবে বর্তমানে তা বন্ধ করা হয়েছে ছাত্র ছাত্রীদের স্বার্থে।
মূলত একশ্রেণীর বহিরাগতদের অনাকাঙ্খিত ব্যবহারই এর জন্য দায়ী; বলুন না, কেই বা চায় উৎসবের নামে সহপাঠীদের আক্রান্ত বা লাঞ্ছিত হতে দেখতে! তাও আবার বহিরাগত বিকৃতকামীদের হাতে! আশাকরি বুঝতে পারছেন বিষয়টি। সুতরাং এদিক থেকে বলতে গেলে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সঠিক কাজ করেছে, অন্তত ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থে।
তবে অন্যদিকে, অসংখ্য ভালোমানুষ, শান্তিনিকেতনপ্রেমী বা রবীন্দ্রপ্রেমী পর্যটক শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের আমেজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, সেটিও বেশ হৃদয় বিদারক। আশাকরি বিশ্ব ভারতী কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন, এবং শীঘ্রই সিকিউরিটি ব্যবস্থা আরো উন্নত করে এই বিশেষ দিনটিতে সকল পর্যটকের প্রবেশাধিকারের ব্যবস্থা করবেন।
উল্লেখ্য বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাসে প্রবেশাধিকার না থাকলেও দোলের ২-৩ দিনের ছুটিতে প্রচুর পর্যটক চলে আসেন শান্তিনিকেতনে; তারা বসন্তোৎসব যাপন করেন মূলত সোনাঝুরির দিকে।
Related: Plan A Memorable Tinchuley Trip
বর্ষা (জুলাই–সেপ্টেম্বর):
কবির প্রথম পছন্দ ছিল শান্তিনিকেতনের বর্ষা। সবুজে ঢাকা প্রকৃতি, টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ আর রোম্যান্টিক, শান্ত পরিবেশ। নবদম্পতি আর প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য একদম উপযুক্ত সময়।
গ্রীষ্মকালে (এপ্রিল–জুন) শান্তিনিকেতন ভ্রমণ এড়িয়ে চলুন, কারণ এই সময় প্রচণ্ড গরম থাকে।
👉 শান্তিনিকেতনের আসল স্বরূপ অনুভব করতে চাইলে উৎসব বা লম্বা ছুটির সময় এড়িয়ে চলা উচিত। কারণ সে সময় ভিড় খুব বেশি হয়, হোটেল ভাড়া ও গাড়ি ভাড়াও বাড়ে মাত্রাতিরিক্তভাবে।

শান্তিনিকেতনের আশেপাশে আরো কিছু ঘোরার জায়গা
১. দেউল – দেখবেন প্রাচীন শিবমন্দির, অজয় নদ, আর দেউল পার্ক
২. বনলক্ষ্মী – এটি মূলত একটি বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট
৩. সবুজ বন – এটি একটি পার্ক, আর সঙ্গে আছে একটি রিসর্ট
৪. ফুল্লরা – এটি লাবপুরের কাছে অবস্থিত আরেকটি শক্তিপীঠ
শান্তিনিকেতনের সেরা হোটেল
শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন বাজেটের হোটেল পেয়ে যাবেন। চালু জায়গায় সস্তার বা প্রিমিয়াম হোটেল পেতে হলে বোলপুর-শান্তিনিকেতন রোডের উপর খোঁজ করুন, প্রচুর হোটেল পাবেন। তবে ভিড় থেকে কিছুটা দূরে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকতে হলে গোয়ালপাড়া, সোনাঝুরি, প্রান্তিক, শ্যামবাটি, রতনপল্লী, বল্লভপুর বা বিনুরিয়ার দিকে থাকুন। এইসব অঞ্চলে অবস্থিত কিছু ভালো হোটেল ও রিসর্টের নাম নিচের তালিকায় দেওয়া দেওয়া রইলো:
বাজেট হোটেল ও হোমস্টে | মিড-বাজেট ও প্রিমিয়াম |
---|---|
তনুবিথি রিসর্ট – আমার কুটির রোড (৪.৬/৫) | মোহর কুটির – বল্লভপুর (৪.৬/৫) |
পঞ্চবন রিসর্ট –তালতোড়, সায়রবিতি পার্ক (৪.৩/৫) | মায়াবন রিসর্ট – উত্তরপল্লী, গোয়ালপাড়া (৪.৭/৫) |
খোয়াই ভিলেজ রিসর্ট – গোয়ালপাড়া (৪.৪/৫) | দ্য ক্রিক – শংকর রোড, বৈরাডিহি (৪.৪/৫) |
মোহর বাড়ি হোমস্টে – পুর্বপল্লী (৪.৯/৫) | মোহুল – প্রান্তিক (৪.৯/৫) |
আয়না হোমস্টে – রতনপল্লী (৪.৮/৫) | শান্তিনিকেতন রিট্রিট – শ্যামবাটি (৪.৫/৫) |
অপরাজিতা হোমস্টে – পুর্বপল্লী (৪.৬/৫) | সোনাঝুরির আড্ডা – বল্লভপুর (৪.৫/৫) |
মৃগণা – ডিয়ার পার্ক, শিক্ষা ভবনের কাছে (৪.৩/৫) | দ্য মাড হাউস – রতনপল্লী (৪.২/৫) |
গুলঞ্চ হোমস্টে – অ্যান্ড্রুজ পল্লী (৪.৪/৫) | বাইনে রিসর্ট – প্রান্তিক (৪.২/৫) |
পার্ক গেস্ট হাউস – ডিয়ার পার্ক, লাল বাঁধ (৩.৮/৫) | আমোলি – রতনপল্লী (৪.১/৫) |
মায়াস – রূপপুর (৪.৪/৫) | রক্তকরবী কারুগ্রাম – রূপপুর, বিনুরিয়া (৪.৪/৫) |
কারাতোয়া – রতনপল্লী (৪.৪/৫) | ছুটি হলিডে রিসর্ট – চারুপল্লী, বোলপুর (৪.১/৫) |
নিভৃতে যতনে – খেলেদাঙা, বল্লভপুর (৪.৯/৫) | শান্তিনিকেতন টুরিস্ট লজ |
বিঃ দ্রঃ পিক সিজনে (পৌষমেলা ও বসন্তোৎসব-দোল) শান্তিনিকেতনের সব হোটেলের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যায়। ৩-৪ দিনের প্যাকেজে বুকিং করতে হয়।
শান্তিনিকেতনে খাবারদাবার
শান্তিনিকেতনে পাবেন বাঙালি, আদিবাসী ও কন্টিনেন্টাল নানা স্বাদের খাবার।
- ঘুরে আসুন রেস্টুরেন্ট – খাঁটি বাঙালি খাবারের জন্য বিখ্যাত।
- হ্যান্ডপিকড বাই অমৃতা – এখানে আগে থেকে প্রি-অর্ডার করতে হয়।
- রামশ্যাম রেস্টুরেন্ট (সোনাঝুরি) – ঘরোয়া রান্নার অসাধারণ স্বাদ।
- খরিমাটি রেস্টুরেন্ট ও বার – নানা ধরনের খাবার ও পানীয় পাওয়া যায়।
- দ্য গার্ডেন রেস্টুরেন্ট
- হেন্সেল ঘর (অমর কুটির)
- বাঁশুরি
- মোহর কুটির
- আথেনিয়াম গ্রিনস
- মহামায়া (বোলপুর স্টেশনের কাছে)
শান্তিনিকেতনে শপিং
- সোনাঝুরি হাট – হাতে তৈরি গয়না, টেরাকোটা শিল্প, ঘর সাজানোর সামগ্রী, আর বাউল গানের আসর। শনিবারে গেলে সবচেয়ে ভালো।
- তানিয়ার নকশিকাঁথা বুটিক – উন্নতমানের নকশিকাঁথা পিওর সিল্ক ও তসর শাড়ি, বাটিক ও হ্যান্ডপেন্টেড সিল্ক শাড়ি, কাঁথাস্টিচ করা পাঞ্জাবি, কুর্তি, ড্রেস মেটেরিয়াল ইত্যাদি পাবেন এখানে; যদি আপনি হাতে বোনা কাঁথা শাড়ীর ভক্ত হন তাহলে অবশ্যই ঘুরে আসুন এখন থেকে।
- আমার কুটির – লেদার জিনিস, বাঁশের হস্তশিল্প, শাল, আর হ্যান্ডওভেন কাপড়—উপহারের জন্য একদম পারফেক্ট।
শান্তিনিকেতনের ইতিহাস ও শিক্ষা সম্পর্কিত তথ্য
উপরে শান্তিনিকেতন ভ্রমণ পরিকল্পনা (Santiniketan Tour Plan) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। এবার আসি একটু অন্য আলোচনায়। নিম্নলিখিত অংশে আমরা শান্তিনিকেতনের ঐতিহাসিক পটভূমি, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ এবং এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব। এই অংশ বিশেষত তাঁদের কাজে লাগতে পারে, যাঁরা বিশ্বভারতীতে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী (হয়তো নিজের জন্য অথবা সন্তানের জন্য)।
তবে যদি আপনি শুধুমাত্র ভ্রমণ পরিকল্পনার জন্য এই নিবন্ধ পড়ছেন, তাহলে পুনরায় জানাই সেই আলোচনা উপরের অনুচ্ছেদেই শেষ হয়েছে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ এবং এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আগ্রহী না হলে আপনি এখানেই থেমে যেতে পারেন।
শান্তিনিকেতনের ঐতিহাসিক ভিত্তি
শান্তিনিকেতনের সূচনা উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে, যিনি এই রাঙামাটির দেশে আধ্যাত্মিক সাধনার রসদ খুঁজে পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র নোবেল বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনকে শিল্প, সংস্কৃতি ও শিক্ষার এক অনন্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন।
১৯০৫ সালে কবিগুরু মাত্র পাঁচজন ছাত্র নিয়ে একটি আশ্রমিক বিদ্যালয় শুরু করেন, যা পরে পাঠভবন নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর দর্শন ছিল যুগান্তকারী—শিক্ষা হবে প্রকৃতির সান্নিধ্যে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে কৃত্রিম দেয়াল বা সীমারেখা ছাড়াই। আজও পাঠভবনে কবির সেই একই দর্শন বজায় রেখে খোলা আকাশের নিচে ছাত্রদের পড়াশোনা করার প্রথা চালু রয়েছে।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশ
ক্রমশ শান্তিনিকেতনে একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে—
- ১৯১৯ সালে বিশ্বখ্যাত শিল্পকলা কেন্দ্র কলাভবন প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ১৯২১ সালে বিদ্যাভবন শুরু হয় (College of Humanity)।
- ১৯৩৩ সালে সংগীত ও নৃত্যের জন্য আলাদা বিভাগ হিসেবে সঙ্গীত ভবন প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতীকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেওয়া হয় এবং Institution of National Importance হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
শুধুই শিল্প-সাহিত্য নয়: বিজ্ঞান বিভাগেও বিশ্বভারতীর পরিচিতি বিশ্বব্যাপী
আমরা দেখেছি, অনেক শিক্ষিত মানুষও একটা ভুল ধারণা পোষণ করেন, এমনকি এই ইন্টারনেট আর এ.আই.-এর যুগেও! —তাঁরা মনে করেন বিশ্বভারতী শুধুমাত্র একটি শিল্পকলা বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়। সম্ভবত এর কারণ কলাভবনের বিশ্বজোড়া খ্যাতি। কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।
আমি নিজেও বারবার এ ধরনের ভুল প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। কয়েক বছর আগে পি.সি. চন্দ্র জুয়েলার্সের একজন কর্মচারী আমাকে বলেছিলেন, বিশ্বভারতী নাকি “শুধু শিল্পের প্রতিষ্ঠান”! আমি বেশ বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ আমি নিজেই এখানে ২০ বছর কাটিয়েছি—সেই ১৯৯৫ সালে বাবা-মায়ের হাত ধরে পাঠভবনে ভর্তি হয়েছিলাম; তারপর ২০ টা বছর কাটিয়ে ২০১৫ সালে বিশ্বভারতী ছেড়েছি। ব্যাচেলর্স, মাস্টার্স, পিএইচডি সম্পূর্ণ করেছি বিশ্বভারতীর রসায়নে বিভাগে; উল্লেখ্য, গবেষণাকালে ১৪টি গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করেছি আর তারই সাথে অল ইন্ডিয়া নেট পরীক্ষায় ৯৩তম স্থান অর্জন করেছি।
সুতরাং বিশ্বভারতী যে শুধুমাত্র শিল্পকলার প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এখানকার বিজ্ঞান বিভাগ যে অত্যন্ত উন্নত তার উদাহরণ হিসাবে আমি নিজেই যথেষ্ট, যদিও আমি সেইঅর্থে এক সাধারণ ছাত্র মাত্র; আমার থেকেও আরো অনেক ভালো ভালো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র আছে যারা বিশ্বভারতীর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাশ করে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বড়ো বড়ো ইনস্টিটিউট ও অন্যান্য সংস্থায় কর্মরত। তাই “বিশ্বভারতী যে শুধুমাত্র শিল্পকলার প্রতিষ্ঠান” এই ভুল ধারণার বিসর্জন হওয়া প্রয়োজন।
- ১৯৬১–৬৩ সালে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত, উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যায় অনার্স কোর্স চালু হয়।
- ১৯৭২ সালে বিশ্বভারতীর বিজ্ঞান সংস্থা হিসেবে শিক্ষাভবন স্বীকৃতি পায়।
- পরে কম্পিউটার বিজ্ঞান, Statistics, ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ চালু হয়।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি যে, বিশ্বভারতীর বিজ্ঞান বিভাগে বিশ্বমানের শিক্ষা প্রদান করা হয়। নিবেদিতপ্রাণ অধ্যাপকরা ছাত্রদের এমনভাবে গাইড করেন যে, প্রাইভেট টিউশনের প্রয়োজন পড়ে না। বিশেষত রসায়ন বিভাগ থেকে প্রতিবছর সর্বাধিক সংখ্যক নেট-যোগ্যতাপ্রাপ্ত ছাত্র বের হয়। পদার্থবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, ও গণিত, বিভাগও যথেষ্ট সফল।
যদি আপনি আপনার সন্তানকে বিশ্বভারতীর বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করার কথা ভাবছেন, তাহলে নিশ্চিন্ত থাকুন—এখানে পড়াশোনার মান অসাধারণ। তবে এর জন্য দরকার আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকা এবং শিক্ষকদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা। এখানে স্বাধীনতা আছে, তাই সঠিকভাবে সাফল্য পেতে ছাত্রকে মনোযোগী হতে হবে এবং নিয়ন্ত্রিত থাকতে হবে।
শ্রীনিকেতন ও গ্রামীণ পুনর্গঠন
১৯২২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রীনিকেতন থেকে গ্রামীণ উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন।
পরবর্তীকালে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিদ্যায় শিক্ষা লাভ করার পর দেশে ফিরে এসে, শ্রীনিকেতনে গ্রামীণ পুনর্গঠন কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন। সেখানে তিনি কৃষি ও সম্প্রসারণ কেন্দ্র স্থাপন করেন, আধুনিক কৃষিযন্ত্র আমদানি করেন, এমনকি আমেরিকা থেকে বীজ ও ল্যাবরেটরি সরঞ্জাম এনে অঞ্চলের কৃষি চর্চার উন্নয়নে উদ্যোগ নেন। বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর তিনিই প্রথম উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৭ সালে জাতীয় কৃষি কমিশনের সুপারিশে (যার সদস্য ছিলেন লিওনার্ড এলমহার্স্ট) Institute of Rural Higher Education চালু হয়। পরবর্তীকালে কাজের সুবিধার্থে সমগ্র পদ্ধতিটিকে আলাদা আলাদা বিভাগে বিভক্ত করা হয়; বর্তমানে পল্লী শিক্ষা ভবন (PSB) এবং পল্লী সংগঠন বিভাগ (PSV) থেকে যথাক্রমে এগ্রিকালচারে ও সোশ্যাল ওয়ার্কে স্নাতক ও মাস্টার্স ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
নবতম সংযোজন: ক্রীড়া ও শারীরিক শিক্ষা
১৯৯৭ সালে বিশ্বভারতীতে সবচেয়ে নতুন বিভাগ হিসেবে চালু হয় শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়াবিজ্ঞান বিভাগ। এর ফলে ক্রীড়া, ফিটনেস এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক পড়াশোনার সুযোগ তৈরি হয়। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিসর আরও বিস্তারিত হয়।
উপসংহার
শান্তিনিকেতনকে কেবলমাত্র একটি গতানুগতিক ভ্রমণস্থল হিসাবে গণ্য করা যায়না—এটি বাঙালির আবেগ, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও শিক্ষার এক মহার্ঘ কেন্দ্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বপ্নের এই ভূমি আজও একইসাথে প্রকৃতিপ্রেমী, শিল্পসন্ধানী, ইতিহাসপিপাসু এবং আধ্যাত্মিকতার অনুসন্ধানীদের মুগ্ধ করে চলেছে।
এখানে একদিকে যেমন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচিহ্নে ভরপুর উত্তরায়ণ আর পাঠভবন আশ্রম চত্বর রয়েছে, রয়েছে কলাভবনের চারুকলার ভাস্কর্য, কিংবা কাঁচমন্দিরের প্রার্থনালয়, তেমনিই অন্যদিকে আছে সোনাঝুরির সবুজ বোন, গ্রামীণ হাট, কোপাই নদীর ধারে শান্ত বিকেল, বল্লভপুরের হরিণ উদ্যান কিংবা প্রকৃতি ভবনের ব্যতিক্রমী সংগ্রহ। প্রতিটি জায়গাই আপনাকে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতিতে ভরিয়ে তুলবে।
বর্তমানকালে হোটেল-রিসর্টের ভিড়ে শান্তিনিকেতন অনেকটাই বদলেছে বটে, তবুও এর মাটির টান, প্রকৃতির নীরবতা আর রবীন্দ্রনাথের আদর্শ আজও জীবন্ত। তাই এখানে এলে শুধুমাত্র একজন হুজুগে পর্যটকের মতো নয়, বরং একজন অন্বেষকের মতো ভ্রমণ করুন—তবেই খুঁজে পাবেন প্রকৃত শান্তিনিকেতনকে।
অবসর সময়ে যদি শহরের কোলাহল থেকে দূরে সরে এসে প্রকৃতি, শিল্প, শিক্ষা আর সংস্কৃতির মিলনভূমিকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে চান, তবে শান্তিনিকেতনই হতে পারে আপনার পরবর্তী সেরা গন্তব্য। প্রাণ ভরে শান্তিনিকেতনকে উপলব্ধি করার জন্য বেছে নিন সঠিক সময় আর উপযুক্ত ভ্রমণ পরিকল্পনা।
যদি আরো কোনো তথ্য জানার থাকে, কমেন্টের মাধ্যমে লিখুন, উত্তর পাবেন অবশ্যই।