জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করার অজুহাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন করে একটি অভিবাসন নিষেধাজ্ঞা (Trump’s Travel Ban) জারি করেছেন, যা আধুনিক মার্কিন ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলির একটি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০২৫ সালের ৯ জুন, রাত ১২:০১ মিনিট (EDT) থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। এতে ১২টি দেশ থেকে আসা নাগরিকদের উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা এবং আরও ৭টি দেশের উপর আংশিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে—যার ফলে ভ্রমণ, অভিবাসন এবং কর্মসংস্থানে ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞায় থাকা ১২টি দেশ হলো — আফগানিস্তান, মিয়ানমার, চাদ, কঙ্গো (ব্রাজাভিল), ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, ইরিত্রিয়া, হাইতি, ইরান, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান এবং ইয়েমেন।
আংশিক নিষেধাজ্ঞায় থাকা ৭টি দেশ হলো — বুরুন্ডি, কিউবা, লাওস, সিয়েরা লিওন, টোগো, তুর্কমেনিস্তান ও ভেনেজুয়েলা।
এই নীতির প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে কলোরাডোর বোল্ডার শহরে ইজিপ্টের এক নাগরিক কর্তৃক ইহুদি সম্প্রদায়ের উপর হামলার পরে (যদিও ইজিপ্ট তালিকায় নেই)। নিষেধাজ্ঞার পেছনে যুক্তি হিসেবে জাতীয় নিরাপত্তা, ভিসা ওভারস্টে রেট এবং মার্কিন অভিবাসন কর্তৃপক্ষের সাথে সহযোগিতার অভাবকে উল্লেখ করা হয়েছে।
৯ জুনের আগের ভিসাগুলোর কী হবে?
বহু মানুষের মনে প্রশ্ন—নতুন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার আগে ইস্যু হওয়া ভিসাগুলোর ভবিষ্যৎ কী? এই বিষয়ে হোয়াইট হাউজের ঘোষণা কিছুটা স্বস্তিদায়ক।
ভিসা বাতিল হবে না
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কর্তৃক স্বাক্ষরিত ঘোষণায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, ৯ জুন ২০২৫-এর আগে ইস্যু হওয়া কোনো অভিবাসী বা অ-অভিবাসী ভিসা এই নীতির কারণে বাতিল করা হবে না। অর্থাৎ, যারা বৈধ ভিসা হাতে পেয়েছেন, তারা নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতার আগে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন।
শর্তসাপেক্ষে প্রযোজ্য
এই রেহাই শুধু তাদের জন্য, যারা নিষেধাজ্ঞার তারিখের আগে ভিসা পেয়েছেন এবং সেই তারিখের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেন।
কিন্তু ৯ জুনের পর যারা নতুনভাবে ভিসার জন্য আবেদন করবেন, এবং তালিকাভুক্ত দেশগুলোর নাগরিক, তারা প্রায় নিশ্চিতভাবেই ভিসা প্রত্যাখ্যানের সম্মুখীন হবেন—যদি না তারা নির্দিষ্ট কিছু ছাড়ের আওতায় পড়েন।
কারা এই নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি পাবেন?
নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিগোষ্ঠী এই নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্ত থাকবেন, যেমন:
- গ্রিন কার্ডধারী স্থায়ী বাসিন্দা
- দ্বৈত নাগরিকত্বধারীরা (যদি তারা নিষিদ্ধ নয় এমন দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করেন)
- কূটনৈতিক ভিসাধারীরা
- অলিম্পিক বা বিশ্বকাপ ইভেন্টে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড় ও তাদের পরিবার
- অভিবাসী ভিসাধারী নিকটাত্মীয়
- দত্তক নেওয়া শিশু
- আফগান বিশেষ অভিবাসী ভিসাধারী
- মার্কিন সরকারের বিশেষ ভিসাধারী কর্মচারী
- ইরানের সংখ্যালঘু ধর্মীয় বা জাতিগত নির্যাতিত জনগণ
নিষেধাজ্ঞার কারণ কী? (Trump’s Travel Ban)

নিষেধাজ্ঞার পেছনে দেশভেদে বিভিন্ন যুক্তি দেওয়া হয়েছে। মূলত তিনটি প্রধান কারণ তুলে ধরা হয়েছে:
১. নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ
আফগানিস্তান
- তালেবান দ্বারা শাসিত, যারা SDGT তালিকাভুক্ত।
- B1/B2 ভিসা ওভারস্টে: ৯.৭%
- শিক্ষার্থীদের ওভারস্টে: ২৯.৩%
ইরান
- সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা, পারমাণবিক আলোচনা স্থগিত।
- দেশটি মার্কিন নিষ্কাশিত নাগরিকদের ফেরত নিতে অস্বীকৃত।
লিবিয়া
- যাচাইয়ের কোনো পরিকাঠামো নেই, চরমপন্থীদের আশ্রয়দাতা দেশ।
ইয়েমেন
- গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত, হুতি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে সরকার নিয়ন্ত্রণহীন।
সোমালিয়া
- “সন্ত্রাসবাদীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল” হিসেবে চিহ্নিত।
- ভিসা যাচাই অক্ষমতা, সরকারি নিয়ন্ত্রণ দুর্বল।
২. ভিসার ওভারস্টে হার অত্যধিক
চাদ
- ট্যুরিস্ট ভিসা ওভারস্টে: ৪৯.৫৪%
- শিক্ষার্থী: ৫৫.৬৪%
হাইতি
- বেআইনি অভিবাসন ও অপরাধের জন্য সমালোচিত।
- ট্যুরিস্ট: ৩১.৩৮%, শিক্ষার্থী: ২৫.০৫%
ইকুয়েটোরিয়াল গিনি
- ট্যুরিস্ট: ২১.৯৮%, শিক্ষার্থী: ৭০.১৮%
কঙ্গো (ব্রাজাভিল)
- ট্যুরিস্ট: ২৯.৬৩%, শিক্ষার্থী: ৩৫.১৪%
মিয়ানমার
- ট্যুরিস্ট: ২৭%, শিক্ষার্থী: ৪২%
৩. প্রত্যাবাসনে সহযোগিতার অভাব
ইরিত্রিয়া
- অপরাধ তথ্য ভাগ করে না, নিরাপদ পাসপোর্ট ইস্যুতে অক্ষম।
- ট্যুরিস্ট ওভারস্টে: ২০%+, শিক্ষার্থী: ৫৫%+
সুদান
- জাল ডকুমেন্ট, দুর্বল যাচাইকরণ।
- ব্যবসায়িক ভিসা: ২৬.৩%, শিক্ষার্থী: ২৮.৪%
আংশিক নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন দেশসমূহ
বুরুন্ডি, কিউবা, লাওস, সিয়েরা লিওন, টোগো, তুর্কমেনিস্তান এবং ভেনেজুয়েলা আংশিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছে। এদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু ভিসা, যেমন গ্রিন কার্ড স্পনসরশিপ, কম সময়ের ভিসা ইত্যাদিতে বিধিনিষেধ জারি হয়েছে।
ভেনেজুয়েলা
- সরকারি তথ্য আদান-প্রদানে অনিচ্ছুক।
কিউবা
- ২০২১ সাল থেকে সন্ত্রাসবাদ সমর্থক হিসেবে তালিকাভুক্ত।
ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব
Trump’s Travel Ban শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি খাতে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। গ্রিন কার্ড ও ওয়ার্ক ভিসা স্পনসর বন্ধ হওয়ায় বহু সংস্থা বিপাকে পড়বে।
বিশ্ববিদ্যালয়, হসপিটাল ও গবেষণা কেন্দ্রগুলিতে ৫.৫ মিলিয়নের বেশি বিদেশি কর্মী রয়েছেন—অনেকেই এই নিষিদ্ধ দেশগুলোর নাগরিক।
বর্তমানে বৈধ ভিসাধারীরা কিছুটা সুরক্ষিত থাকলেও ভবিষ্যতের অভিবাসন চিত্র অস্পষ্ট। মানবাধিকার ও আইনি লড়াই বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।
সূত্র: BBC News, Economic Times, The Guardian, Mint