এই বর্ষার মরসুমে ছোট্ট একটা ট্যুর না হলেই নয়; দূরে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে খুব একটা নেই, আবার কাছাকাছির মধ্যে কোথায় ঘুরতে যাবেন ঠিক করতে পারছেন না, তাই তো? দিঘা-পুরী, অথবা পুরুলিয়া বা শান্তিনিকেতন, সবটাই গিয়ে গিয়ে একঘেয়ে হয়ে গেছে; দার্জিলিং-এ আবার বর্ষায় ধস নামে! তাহলে ৩ দিনের ছুটিতে যাবেনই বা কোথায়! আমি বলি, দী-পু-দা গন্ডি থেকে বেরিয়ে এসে একবার ঘুরে আসুন রাঁচি থেকে; অসাধারণ অভিজ্ঞতা হবে। বর্ষায় ঘোরার জন্য রাঁচি একদম পারফেক্ট। কেন বর্ষায় যাবেন, রাঁচির কোথায় ঘুরবেন (Ranchi Tourist Attractions), কিভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন, সমস্ত বৃত্যন্ত নিয়ে আজকের উপস্থাপনা।
Read in English | हिंदी में पढ़ें
সূচিপত্রে এক ঝলক
বর্ষার মরসুমে রাঁচিতে কেন ঘুরতে যাবেন?
১. জলপ্রপাতের প্রকৃত রূপ দর্শন
রাঁচির আশেপাশে অসংখ্য ছোট বড় জলপ্রপাত আছে, যেগুলি বর্ষার সময় সম্পূর্ণ রূপে জীবন্ত হয়ে ওঠে। দসম ফলস, হুন্দ্রু ফলস, জোন্হা ফলস-এর মতো দর্শনীয় ঝর্ণাগুলি বর্ষার প্রবল বৃষ্টিতে ফুলে ফেঁপে ওঠে এবং চোখ ধাঁধানো দৃশ্য উপহার দেয়।
২. সবুজে মোড়ানো উপত্যকা ও বনাঞ্চল
বর্ষাকালে রাঁচির উপত্যকা ও পাহাড়ঘেরা অঞ্চলগুলো ঘন সবুজ হয়ে ওঠে। পাত্রাতু ভ্যালি বলুন আর রাস্তার ধরে বেড়ে ওঠা বন্য প্রকৃতিই বলুন, বৃষ্টিভেজা মরসুমে রাঁচির চারিপাশ সেজে ওঠে এক চোখ জুড়ানো দৃশ্য নিয়ে।
৩. আরামদায়ক আবহাওয়া
রাঁচির বর্ষাকাল তুলনামূলকভাবে ঠাণ্ডা ও স্বস্তিদায়ক। তাপমাত্রা সাধারণত ২২°C থেকে ৩০°C-এর মধ্যে থাকে, যা গ্রীষ্মকালীন ঝাঁঝাল গরম থেকে স্বস্তি দেয়।
রাঁচির সেরা ১০টি ভ্রমণস্থান (Ranchi Tourist Attractions)
আসুন ঝট করে দেখেনি রাঁচির সেরা ১০ টি জায়গা কোনগুলি।
১. দসম জলপ্রপাত (Dassam Falls)

রাঁচি শহর থেকে প্রায় ৪০ কিমি দূরে অবস্থিত এই জলপ্রপাতটি বর্ষার সময় বিশেষ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কানচি নদীর জল ধাপে ধাপে ১৪৪ ফুট নিচে পড়ে এক অপূর্ব দৃশ্য তৈরি করে। চারদিকে ঘন বন এবং গর্জন করা ঝরনার শব্দ মিলেমিশে এক মোহময় পরিবেশ তৈরি করে।
বিশেষ টিপস: স্রোতের তীব্রতা বেশি থাকার কারণে বর্ষায় এখানে স্নান করা একেবারেই নিরাপদ নয়।
২. সূর্য মন্দির (Surya Temple)

দসম জলপ্রপাত থেকে ১৬ কিমি দূরে অবস্থিত এই সূর্য মন্দিরটি রথ-আকৃতির স্থাপত্যশৈলীর জন্য বিখ্যাত। মন্দিরের ভিতরের এবং বাইরের নিপুন কারুকার্যের পাশাপাশি এ অঞ্চলের জঙ্গল পথ পাহাড় প্রকৃতি সবকিছু বর্ষায় ঘন সবুজের আবরণে ঢেকে যায়; মন্দিরপ্রাঙ্গন ফুটে ওঠে এক প্রশান্তিপূর্ণ আধ্যাত্মিক পরিবেশ।
৩. হুন্দ্রু জলপ্রপাত (Hundru Falls)

হুন্দ্রু ফলস হলো ঝাড়খণ্ডের অন্যতম উচ্চতম জলপ্রপাত . সুবর্ণরেখা নদীর জল ৩২০ ফুট উচ্চতা থেকে ধাপে ধাপে নিচে নেমে এস প্রবল বেগে। বর্ষাকালে জলধারা হয়ে ওঠে প্রচন্ড শক্তিশালী, আর একই সাথে সৌন্দর্যপূর্ণ। রোমাঞ্চপ্রিয় পর্যটকদের জন্য এটি একটি দুর্দান্ত স্থান।
মনে রাখবেন: প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে প্রায় ৭০০ সিঁড়ি অতিক্রম করার পর জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছানো যায়। বিকেল ৪ টের সময় প্রবেশদ্বার বন্ধ হয়ে যায়, অবশ্যই তার আগে পৌঁছাবেন।
৪. জোনহা জলপ্রপাত (Jonha Falls)

জোনহা ফলস উপরে উল্লিখিত দাসম বা হুন্দ্রু ফ্লসের তুলনায় কম জনপ্রিয় হলেও এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাস্তবেই অসাধারণ। রাঁচি থেকে ৪২ কিমি দূরে অবস্থিত এই ঝরনাটি গৌতমধারা জলপ্রপাত নামেও পরিচিত। তুলনামূলক ভাবে এখানে ভিড় কম থাকায়, আপনি যদি একান্তে শান্তিপূর্ণভাবে কিছুটা সময় কাটাতে চান তাহলে এই জায়গাটি একেবারে আদর্শ।
প্রায় ৪০০ সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয় জোনহা ফলসের সামনে পৌঁছানোর জন্য।
৫. সীতা জলপ্রপাত (Sita Falls)

জোণহা মাত্র ৪ কিমি দূরে অবস্থিত, এই অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ঝরনাটি রাধু নদীর জলধারায় সৃষ্টি। ৩০০ ধাপ সিঁড়ি দিয়ে নেমে পৌঁছাবেন সীতা ফলস ভিউ পয়েন্টে। এরপর আপনি ইচ্ছা করলে জলধারা পেরিয়ে পাথুরে পথ বেয়ে আরো কাছে এগিয়ে যেতে পারেন, তবে বর্ষায় জলের তোড় বেশি থাকে, আর পাথর ও পিছল হয়ে থাকে; তাই সাবধান। জঙ্গলের ভিতর শান্তি আর প্রকৃতির ছোঁয়া একত্রে অনুভব করা যায় সীতা ফলসে গেলে।
৬. গেতালসুদ ড্যাম (Getalsud Dam)

রাঁচির শহর থেকে বেশ কিছুটা বাইরে অবস্থিত এই ড্যামটি বর্ষায় এক অপূর্ব রূপ ধারণ করে। মাঝবর্ষার যখন জলাধারের লকগেট খোলা থাকে আর বিশাল জলধারা নির্গত হয় – সে এক চমৎকার দৃশ্য! মেঘে ঢাকা পাহাড়, সবুজে ঘেরা রাস্তা, আর তার মাঝখান দিয়ে গাড়ি চালিয়ে গেতালসুদ ড্যামে পৌঁছানোর মধ্যে রয়েছে এক আলাদা অনুভূতি।
৭. পাত্রাতু ভ্যালি ও লেক (Patratu Valley)

পাত্রাতু উপত্যকার পথে যাত্রা করাই এক মনোরম অভিজ্ঞতা, সে যে মরসুমেই হোক না কেনও। তবে বর্ষাকালে এই পথ হয়ে ওঠে সবুজে ভরা, মেঘে ঢাকা আর বৃষ্টিভেজা। উপত্যকার উপর থেকে সমগ্র ভ্যালি আর পাত্রাতু ড্যামের দৃশ্য একেবারে মনোমুগ্ধকর। নিচে নেমে পাত্রাতু লেকে নৌকা ভ্রমণ করাও এখানকার বিশেষ আকর্ষণ।
থাকার ব্যবস্থা: মিডওয়ে রিসর্ট, দা ইটার্নিটি, পাত্রাতু লেক রিসর্ট
৮. রক গার্ডেন ও কাঙ্কে ড্যাম

শহরের মধ্যেই অবস্থিত রাশি রক গার্ডেনটি প্রাকৃতিক শিলাস্তম্ভ, ও কৃত্রিম কাঠামোর সংমিশ্রনে সাজানো। ছোটদের জন্য তৈরী করা আছে খেলাধুলার নানা কিছু , রাঁচি রক গার্ডেন থেকে পার্শবর্তী কাঙ্কে ড্যামের দৃশ্যসহ বিকালের দিকে দারুন সূর্যাস্ত দেখা যায় , কাঙ্কে ড্যামে নবীরের ব্যবস্থাও আছে, তবে তার জন্য বেশ কিছুটা নিচে নামতে হয়
৯. ভগবান বিরসা বায়োলজিক্যাল পার্ক (Ranchi Zoo)
এই বায়োলজিক্যাল পার্কটি বর্ষাকালে আরও সবুজ হয়ে ওঠে। এখানে বাঘ, সিংহ, ভাল্লুক, পাখি, সরীসৃপ প্রজাতির বহু প্রাণী রয়েছে। পরিবার বা বাচ্চাদের সঙ্গে ঘুরতে গেলে এটি একটি চমৎকার জায়গা।
টিপস: ছাতা ও হালকা রেইনকোট সঙ্গে রাখুন।
১০. টেগোর হিল (Tagore Hill)
এই শান্ত পাহাড়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামানুসারে পরিচিত। সহজে ওঠা যায় এবং বর্ষার কুয়াশায় আচ্ছন্ন এই পাহাড়টি এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করে। পাহাড়ের উপর থেকে দেখা যায় রাঁচি শহরের দারুন দৃশ্য।
রাঁচির আশেপাশে ঘোরার আরোও কিছু মনোরম গন্তব্য
- নেতারহাট: ছোটনাগপুরের রানী নামে পরিচিত এই হিল স্টেশন বছরের যেকোনো সময়ে যাওয়ার জন্য এক দুর্দান্ত গন্তব্য।
- বেতলা ন্যাশনাল পার্ক: বন্যপ্রাণীপ্রেমীদের জন্য আদর্শ স্থান, বর্ষাকালে এটি সবুজে ভরে ওঠে।
- লোধ জলপ্রপাত: নেতারহাট থেকে প্রায় ৭০ কিমি দূরে অবস্থিত লোধ ফলস হলো ঝাড়খণ্ডের উচ্চতম জলপ্রপাত।
রাঁচিতে কী কী করবেন?
- নেচার ফটোগ্রাফি: ঝরনা, বন, ও মেঘলা আকাশের ফ্রেমগুলো দুর্দান্ত।
- হালকা ট্রেকিং: জলপ্রপাতগুলির আশেপাশে অলসস্বল্প ট্রেক করতে বেশ ভালোই লাগবে ।
- স্থানীয় খাবার উপভোগ: জলপ্রপাতগুলির আশেপাশের দোকানগুলিতে দেশি মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে দেখুন; আহা দারুন স্বাদ।
- লোকাল মার্কেট: ঝাড়খণ্ডের হস্তশিল্প ও আদিবাসী হ্যান্ডলুম ঘুরে দেখতে পারেন।
রাঁচিতে কোথায় থাকবেন?
রাঁচিতে সব ধরনের বাজেটের জন্য হোটেল আছে। বর্ষায় সেন্ট্রাল লোকেশন বেছে নিন যাতে জলপ্রপাত ও পাহাড়ে সহজে পৌঁছাতে পারেন।
সেরা কিছু হোটেল:
- Radisson Blu Ranchi – ৫ তারা হোটেল
- Hotel Capitol Hill – মধ্য বাজেটের হোটেল
- Hotel Green Horizon – স্বল্প বাজেটের হোটেল
- Divisha Hotel Marina – স্বল্প বাজেটের হোটেল
- The Eternity (Patratu-এর কাছে)
রাঁচিতে কীভাবে যাবেন?
- বিমানপথে: বিরসা মুন্ডা বিমানবন্দর দিল্লি, কলকাতা, মুম্বাই, বেঙ্গালুরুর সঙ্গে যুক্ত।
- রেলপথে: রাঁচি জংশন ভারতের বড় শহরগুলির সঙ্গে সংযুক্ত। হাওড়া থেকে রাঁচি পৌঁছানোর জন্য বেশ কয়েকটা ট্রেন আছে।
- সড়কপথে: NH-৩৩ ও NH-৪৩ দ্বারা রাঁচি গোটা দেশের সাথে সংযুক্ত। জামশেদপুর, ধানবাদ বা পাটনা থেকে বাস পাওয়া যায়। আবার আপনি নিজের গাড়ি নিয়েও রাঁচি পৌঁছে যেতে পারেন।
বর্ষাকালে রাঁচি ভ্রমণের জন্য কিছু দরকারি টিপস
- ছাতা বা রেইনকোট সঙ্গে রাখুন।
- নন-স্লিপ জুতো পরুন।
- ঝরনায় স্নান থেকে বিরত থাকুন।
- অতিরিক্ত সময় হাতে রাখুন (বৃষ্টি বা জ্যামের কারণে)।
- আগেই হোটেল বুক করে রাখুন।
শেষ কথা
বর্ষাকালে রাঁচি এক স্বপ্নের মতো জায়গা। ঘন সবুজ বন, বিশাল জলপ্রপাত, ঠাণ্ডা হাওয়া আর পাহাড়ি পথ – সবকিছু মিলে এটি বর্ষার অন্যতম সেরা ভ্রমণস্থান হয়ে উঠেছে। যাঁরা কম ভিড়, প্রকৃতি আর শান্তি খোঁজেন, তাঁদের জন্য রাঁচির ভ্রমণস্থানগুলি (Ranchi tourist attractions) এক অনন্য অভিজ্ঞতা দিতে পারে। এবার দীঘা পুরী বা দার্জিলিঙের ভিড় এড়িয়ে ঘুরে আসুন রাঁচির কোলে থাকা এক টুকরো স্বর্গ থেকে।