আজকের বিশ্বে ব্যবসা বা বিনোদনের যেকোনো উদ্দেশ্যে যাত্রার ক্ষেত্রে বিমানে ভ্রমণ আমাদের প্রত্যেকের কাছেই খুব সাধারণ ব্যাপার, বলতে পারেন এটি আমাদের অনেকের কাছেই একটি অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। ভ্রমণ হোক বা কর্পোরেট মিটিং—বিমানই সবচেয়ে দ্রুত এবং সুবিধাজনক মাধ্যম, একথা বলাই বাহুল্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই বাণিজ্যিক বিমানের জগতে ‘Boeing 787 Dreamliner’ অন্যতম উন্নত, জ্বালানি-সাশ্রয়ী এবং যাত্রীবান্ধব বিমান হিসাবে পরিচিত।
কিন্তু যদি একটি নিরাপদ বিমান এমন ভয়ানক বিমান দুর্ঘটনার কারণে ইতিহাসে জায়গা করে নেয়, তখন প্রশ্ন উঠে যায় — কোথায় নিরাপত্তা, বিশ্বাসযোগ্যতাই বা কোথায়?
১২ জুন, ২০২৫। এয়ার ইন্ডিয়ার একটি Boeing 787-8 Dreamliner আহমেদাবাদ বিমানবন্দর থেকে ওড়ার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ভূপতিত হয়ে বিধ্বস্ত হয়। এই হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা যেমন পুরো দেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছে এবং তেমনিই বিমানের নিরাপত্তা, বিমানবন্দরের পরিবেশ এবং রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া নিয়ে বেশ কিছু গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
Boeing 787 Dreamliner-এর মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটির সংক্ষিপ্ত চিত্র
দুপুর ১:৩৯ মিনিটে, লন্ডনগামী এআই-১১৭ ফ্লাইটটি আহমেদাবাদ থেকে যাত্রা শুরু করে। বিমানে ছিলেন ২৩০ জন যাত্রী, পাইলটদ্বয়, এবং ১০ জন ত্রু সদস্য। উড্ডয়নের মাত্র ২০–৩০ সেকেন্ডের মধ্যে পাইলটরা একটি Mayday সংকেত দেন। কিন্তু ততক্ষণে আর কিছুই করার সময় ছিল না। বিমানটি চোখের পলকে নিম্নগামী হয়ে কাছের একটি হাসপাতাল ভবনে ধাক্কা খেয়ে বিস্ফোরিত হয়।
২৪২ জনের মধ্যে শুধুমাত্র একজন বেঁচে যান—যুক্তরাজ্যের নাগরিক, বিশ্বাসকুমার রমেশ, যিনি ১১এ সিটে বসেছিলেন। উদ্ধার করার পর তিনি নিজেই অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত হেঁটে যান।

হাসপাতালের সর্বোচ্চতলে অবস্থিত ক্যান্টিনে বসে খাবার খাচ্ছিলেন এমন ৫ জন ডাক্তার ঘটনাস্থলেই মারা যান। আরও অনেকে ভয়াবহ আহত হন। মোট প্রাণহানির সংখ্যা এখনও নিশ্চিত না হলেও, এটি ইতিমধ্যেই ভারতের অন্যতম ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
Boeing 787 Dreamliner-এর কি কিছু ভুল হয়েছিল?
বিমান উড্ডয়নের সময় V1 স্পিড অতিক্রম করার পরে তা আর থামানো যায় না—তখন যেকোনো মূল্যে উড্ডয়ন সম্পন্ন করতে হয়। ওই ফ্লাইটটি V1 অতিক্রম করে ৬০০ ফুট পর্যন্ত উড়তে পেরেছিল, কিন্তু এই উচ্চতা যথেষ্ট ছিল না—না স্থিতিশীল হওয়ার জন্য, না বিকল্প ল্যান্ডিংয়ের জন্য।
এত কম উচ্চতায় পাইলটদের হাতে খুবই অল্প সময় ছিল, ফলে তারা বিমানটিকে নিরাপদ জায়গায় নামানোর কোনো সুযোগ পাননি।
সম্ভাব্য কারণ: V1-এর পর পর্যাপ্ত থ্রাস্ট না পাওয়া, যা ইঞ্জিনের ত্রুটি, জ্বালানি লাইন বন্ধ হয়ে যাওয়া, পাখির সাথে ধাক্কা (Bird Strike), বা মানবিক ভুলের (human error) কারণে হতে পারে; এমনকি অন্তর্ঘাতের (sabotage) মতো ঘটনাও হতে পারে—বিশেষত সাম্প্রতিক “সিন্দুর অপারেশন”-এর পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সন্দেহ থাকা স্বাভাবিক।
সম্ভাব্য কারণ: Boeing 787 Dreamliner দুর্ঘটনার গভীর বিশ্লেষণ
১. বার্ড স্ট্রাইক
নগরঘেঁষা বিমানবন্দরে বার্ড স্ট্রাইক এখন প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। শুধু আহমেদাবাদ বিমানবন্দরেই গত কয়েক বছরে একাধিক বার্ড স্ট্রাইকের ঘটনা ঘটেছে। আবর্জনা কেন্দ্র এবং বসবাসযোগ্য এলাকা কাছাকাছি থাকলে শকুন, কাকসহ নানা পাখি সেখানে ভিড় করে। কলকাতা বিমানবন্দরেও একটি বিশাল ডাম্পিং গ্রাউন্ড আছে, যা বারবার বিমান ওঠা নামার সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মাত্র ১.৫ কেজি ওজনের একটি শকুন, বিমানের একটি ইঞ্জিনকে সম্পূর্ণ অকেজো করে দিতে পারে।
এই দুর্ঘটনার পেছনেও বার্ড স্ট্রাইক অন্যতম কারণ হতে পারে, তবে একসঙ্গে দুটি ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা খুবই বিরল—কিন্তু একেবারে অসম্ভব নয় যদি একই সঙ্গে অনেক পাখি সামনে পড়ে।
২. জ্বালানি লাইন ব্লক বা রক্ষণাবেক্ষণ ত্রুটি
Boeing 787 Dreamliner-এ দুটি ইঞ্জিন থাকে এবং একটি অকেজো হলেও অন্যটি চালু থাকার কথা। কিন্তু যদি দুটি ইঞ্জিনই একসঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়, তবে এটি হয়তো জ্বালানি লাইন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়—এধরণের ঘটনা রক্ষণাবেক্ষণ দলের ভুলের কারণে ঘটতে পারে।
এই বিমানটি দুর্ঘটনার আগের দিনও দিল্লি-প্যারিস-দিল্লি এবং পরে দিল্লি-আহমেদাবাদ রুটে চলাচল করেছিল। এক পাইলটের বক্তব্য অনুযায়ী, লীজের অর্থ পূরণ করতে সাধারণত একটি বিমানকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ১৭ ঘণ্টা পরিষেবা দিতে হয়, যার ফলে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাত্র ৫–৭ ঘণ্টা সময় থাকে। এত কম সময় হাতে থাকার ফলে সুক্ষ অথচ গুরুতর ত্রুটি নজর এড়িয়ে যেতে পারে।
যতক্ষণ না তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে, তার আগে পর্যন্ত তৃতীয় কারণ সম্পর্কে মোট প্রকাশ করা সম্ভব নয়, তো তৃতীয় কারণস্বরূপ অন্তর্ঘাতের আশংকা উড়িয়েও দেওয়া যাচ্ছে না।
Boeing 787 Dreamliner-এর বৈশিষ্ট্য
এই দুর্ঘটনার পরেও, ভুলে গেলে চলবে না যে Boeing 787 Dreamliner বিশ্বব্যাপী অন্যতম নিরাপদ এবং আধুনিক বিমান হিসেবে পরিচিত। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো হল:
- এটি মূলত কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি, ফলে হালকা এবং মজবুত।
- ‘সিন্থেটিক ভিশন’ ও ‘ইন্টিগ্রেটেড মডুলার অ্যাভিওনিক্স’-এর মতো উন্নত প্রযুক্তি এতে রয়েছে।
- এটি একটানা ৭,৩০০ নটিক্যাল মাইল উড়তে সক্ষম—আন্তর্জাতিক ভ্রমণের জন্য আদর্শ।
- বড় ও ডিমেবল জানালা, উন্নত আলো ও শব্দনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যাত্রীদের আরামদায়ক অভিজ্ঞতা দেয়।
তবে, এই বিমানটির ২৩ লাখ যন্ত্রাংশের একটিও ভারতে তৈরি হয় না। অথচ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব থাকে ভারতীয় গ্রাউন্ড স্টাফদের হাতে—যারা থার্ড পার্টি কোম্পানির অধীনে কাজ করেন। এই নির্মাণ ও সার্ভিসিং ব্যবস্থার ব্যবধান অনেক সময় প্রযুক্তিজ্ঞানগত ঘাটতি তৈরি করে।
বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ: বিমানবন্দর নিরাপত্তা ও কর্মী ঘাটতি
এই দুর্ঘটনা আরও একটি বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে—ভারতের শহরতলির বিমানবন্দরগুলি বিশেষ করে মেট্রো শহরগুলোতে বেশিরভাগ বিমানবন্দরই ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় ঘেরা। ফলে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে বিমান যদি যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে উড়ান সম্পন্ন করতে না পারে, সেক্ষেত্রে বন্দরের পার্শবর্তী অঞ্চলে নিরাপদভাবে নামানোর মতো অবকাশ নেই। কাছাকাছি অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলা আবর্জনার স্তূপ ও উঁচু ইমারতগুলো এক্ষেত্রে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
লক্ষণীয়, বিদেশের বেশিরভাগ বিমানবন্দরগুলোর চারিপাশে অনেকটা জায়গা অবধি ফাঁকা সমতলে বেষ্টিত থাকে; কারণটা আশাকরি এখন নিশ্চয় অনুধাবন করলেন?
ভারত ২০৪৭ সালের মধ্যে ৩৫০টি বিমানবন্দর ও ৩,০০০টি বিমান চালানোর পরিকল্পনা করছে, অথচ দক্ষ কর্মী, রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৌশলী ও অভিজ্ঞ পাইলটের যথেষ্ট অভাব। সরকার যদি এই দিকগুলিতে নজর না দেয়, তাহলে নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয় ঘটার সম্ভবনা রয়ে গেলো।
উড়ানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভারত সরকারের গভীর নজর দেওয়া প্রয়োজন
এমন একটি ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার পর পাইলট, এয়ারলাইন, বা বিমান প্রস্তুকারী সংস্থার উপর দায় চাপানোটা সহজ এবং স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু হয়তোবা বাস্তবতা অনেক বেশি জটিল। ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার হলে আসল কারণ বোঝা যাবে—তা মানবিক ভুল, যান্ত্রিক ত্রুটি, কাঠামোগত অবহেলা, বা নাশকতা, যাই হোক না কেন।
ভারতের বেসরকারি বিমান সংস্থা বৃদ্ধি দ্রুত এগিয়ে চলেছে, কিন্তু এই জায়গায় সংস্থার উপর সমস্ত দায় বর্তে দিয়ে সরকারের প্রায় দর্শকের ভূমিকা নেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। আরও কঠোর নিরাপত্তা নিরীক্ষা, বাধ্যতামূলক সার্ভিসিং, এবং দৃঢ় তদারকি দরকার। বিমানের সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই মূল কথা। সে রেলপথ হোক আর বিমানপথ, অথবা সড়কপথ।
ভারতীয় প্রতিভাকে কাজে লাগানোর সময় এসেছে
এই দুর্ঘটনার অন্যতম দুঃখজনক দিক হলো, Boeing 787 Dreamliner-এর একটি যন্ত্রাংশও ভারতে তৈরি হয় না—যদিও এটি ভারতের বিমান সংস্থা ব্যবহার করে।
২৩টি আইআইটি, ২২০০+ সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ৬৬০০+ প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং হাজারো বিজ্ঞান কলেজ থাকা সত্ত্বেও দেশের এমন হাল কেন? ইঞ্জিনিয়ারিং, বৈজ্ঞানিক, রাসায়নিক, অথবা ডাক্তারি, কোনো বিষয়েই নতুন লোকহিতকর কোনো আবিষ্কার নেই কেন? তবে কি সঠিক প্রযুক্তিগত প্রাকটিক্যাল শিক্ষা পাচ্ছে না ছাত্ররা, ভারতীয় শিক্ষা কি শুধু থিওরির উপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে?
দ্বিতীয়ত, ভারতীয় মেধাবীরা কেনই বা বিদেশে চলে যান? কারণ, দেশে নেই উপযুক্ত চাকরি যেকাহে ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্সের অভাব, নেই যথোপযুক্ত বেতন বা গবেষণার পরিকাঠামো।
যদি সত্যিই “Make in India” বাস্তবায়ন করতে হয়, তবে গবেষণা, উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠান, এবং বৈজ্ঞানিক প্রকল্পে সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করতে হবে। উপযুক্ত ছাত্রদের সঠিক সুযোগ দিতে হবে, ওয়ার্ক লাইফ ব্যালান্স করে উপযুক্ত বেতনসহ চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু স্লোগানে কাজ হবে না—প্রয়োজন বাস্তব পদক্ষেপ।
শেষ কথা
একজন যাত্রী হিসাবে বিমানে ওঠার সময় আমরা সম্পূর্ণভাবে পাইলট ও প্রযুক্তির উপর ভরসা করি। Boeing 787 Dreamliner যুগান্তকারী প্রযুক্তির প্রতীক হলেও, যদি রক্ষণাবেক্ষণ, তদারকি এবং পরিকাঠামো সঠিক না হয়, তাহলে সেই প্রযুক্তিও ব্যর্থ। এই দুর্ঘটনা নিঃসন্দেহে একটা সতর্কবার্তা।
আমরা শোক প্রকাশ করছি নিহত পরিবারগুলির প্রতি। একমাত্র বেঁচে থাকা যাত্রী বিশ্বাসকুমার রমেশ ও অন্যান্য আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।
আমরা অদূর ভবিষ্যতে যখনি প্লেনে চাপতে যাবো তখনিই এই ঘটনার স্মৃতি ভেসে উঠবে আমাদের চোখের সামনে; নিরাপত্তার কোনো বিকল্প নেই।