আজকের যুগে পরিবেশ দূষণ নিয়ে চিন্তিত গোটা বিশ্ব, আমাদের ভারতবর্ষও তার ব্যতিক্রম নয়; বায়ু দূষণের কারণে যেমন পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে প্রতিদিন, পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে নিত্যনতুন রোগ ও উপসর্গ। এমতাবস্থায় লাদাখে বাণিজ্যিকভাবে চালু হতে চলেছে দেশের প্রথম হাইড্রোজেন চালিত বাস (hydrogen-powered bus), যা পরিবেশ বান্ধব পরিবহন ব্যবস্থাকে উন্নীত করার পথে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
উল্লেখ্য, এই সপ্তাহে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা NTPC Limited লাদাখ প্রশাসনকে পাঁচটি হাইড্রোজেন চালিত বাস আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেছে। খুব শীঘ্রই বাসগুলি গণপরিবহনের পরিষেবা শুরু করতে চলেছে।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে, দেশের প্রথম হাইড্রোজেন চালিত বাস পরিষেবার জন্য লাদাখের মতো চ্যালেঞ্জিং জায়গাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এই বাসগুলো ১১,০০০ ফুটেরও বেশি উচ্চতায়, বিশ্বের সর্বোচ্চ মোটরচালিত পথে চলাচল করবে, যেখানে অনেকসময় প্রচলিত যানবাহন যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়ে থাকে।
উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ:
- ভারতের প্রথম বাণিজ্যিক হাইড্রোজেন‑ফুয়েল সেল বাস লেহ, লাদাখে চালু।
- এগুলি ১১,৫৬২ ফুট উচ্চতায়, বিশ্বের সর্বোচ্চ মোটর চালিত পথে চলাচল করবে।
- ১.৭ MW সৌর‑চালিত হাইড্রোজেন ফুয়েলিং স্টেশন দ্বারা সমর্থিত।
- বছরে ৩৫০ মেট্রিক টন CO₂ কমিয়ে ২৩০ মেট্রিক টন অক্সিজেন উৎপাদনে সক্ষম।
- এটি ভারত সরকারের ন্যাশনাল গ্রীন হাইড্রোজেন মিশন এবং NTPC‑এর সবুজ শক্তি নীতি বাস্তবায়নের অংশ।
“Hydrogen-powered bus” লেহতে ইতিহাস গড়ল

জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে (২০২৫) লেহ শহরের পালাম এলাকায় NTPC এর Green Hydrogen Mobility Station-এ এই বাস-হস্তান্তর অনুষ্ঠিত হয়। বাসগুলি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যা −৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়ে নিম্ন তাপমাত্রায় এবং চরম উচ্চতায় কার্যকরভাবে চলতে সক্ষম। বর্তমানে বাসগুলি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে Sindhu Infrastructure Development Corporation (SIDCO) নাম একটি সংস্থা।
সূর্য ও হাইড্রোজেনের শক্তিতে চালিত বাস
এই প্রকল্পের একটি বড় দিক হলো এটি সম্পূর্ণভাবে পরিবেশবান্ধব। বাসগুলোকে চালনার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ১.৭ MW সৌর শক্তিচালিত একটি হাইড্রোজেন ফুয়েলিং স্টেশন; ফুয়েলিং এর জন্য ব্যবহৃত হাইড্রোজেন সম্পূর্ণভাবে পরিবেশ বান্ধব ও পুনর্ব্যবহার যোগ্য। ৩৫০ বার বায়ুচাপে হাইড্রোজেন সরবরাহ করা হচ্ছে, যাতে তীব্র শীতেও refueling করা সম্ভব হয়।
এই প্রকল্পের ফলে পরিবেশগতভাবে দুটি লাভ হতে চলেছে:
- বছরে ২৩০ মেট্রিক টন অক্সিজেন উৎপাদিত হবে
- ৩৫০ মেট্রিক টন কার্বন নির্গমন কমবে
মোটের উপর প্রকল্পটির কার্যকারিতা ১৩,০০০ গাছ রোপণের সমতুল্য।
ভারতে পরিবেশবান্ধব পরিবহন প্রচেষ্টায় “Hydrogen-powered bus” এর মডেল
NTPC, ভারতের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎ সংস্থা, বর্তমানে ৮১ GW installed power capacity-র এনার্জি ধারণ করতে সক্ষম; পাশাপাশি ২০৩২ সালের মধ্যে ৬০ GW renewable energy capacity-র লক্ষ্য রাখছে।
লেহ প্রকল্পটি পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থান।
এই উদ্যোগ ভারতের ন্যাশনাল গ্রীন হাইড্রোজেন মিশন এর একটি বড় পদক্ষেপ, যা ২০২৩ সালে ₹১৯,৭৪৪ কোটি বাজেটে প্রবর্তিত হয়েছিল। এই মিশনের উদ্দেশ্য হল পরিবেশ বান্ধব হাইড্রোজেন উৎপাদন, ব্যবহার ও রপ্তানির মাধ্যমে ভারতকে বিশ্বব্যাপী একটি পরিবেশ সচেতন দেশে পরিণত করা।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক অতীতে নভেম্বর ২০২৪-এ, NTPC লেহ-তে ভারতের প্রথম উচ্চ চাপ হাইড্রোজেন স্টেশন স্থাপন করেছিল।
দেশেজুড়ে চলছে Hydrogen mobility–র পরীক্ষা নিরীক্ষা
যদিও লেহতে ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য “hydrogen-powered buses” বাণিজ্যিকভাবে চালু হয়েছে, তবে হাইড্রোজেন পরিবহনের জল্পনা শুধুমাত্র লাদাখেই সীমাবদ্ধ নয়। ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন শহরাঞ্চলে Tata Motors হাইড্রোজেন চালিত ফুয়েল সেল বাসের (FCEV) টেস্ট-ড্রাইভ চালাচ্ছে, এবং খুবই সাম্প্রতিককালে তারা হাইড্রোজেন চালিত ট্রাকও পরীক্ষামূলকভাবে চালু করেছে। এই সব উদ্যোগ কেন্দ্রসরকারী প্রকল্পের আওতাভুক্ত, যা হাইড্রোজেনকে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে সরকারিভাবে চালু করার প্রচেষ্টার অংশ।
কেন লাদাখকে বেছে নেওয়া হলো?
লাদাখের উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে এবং অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রার কারণে জায়গাটি পরিবেশগতভাবে চরমভাবাপন্ন, যা বহু প্রচলিত যানবাহনকে বেগ দিয়ে থাকে। প্রায় ১১,০০০ ফুট উচ্চতায়, প্রযুক্তিগত দিক থেকে চরম শৈত্য, শুস্ক পরিবেশ ও পাথুরে রাস্তাতে “hydrogen-powered buses” এর সফল পরীক্ষা, এই প্রযুক্তির ভরসাযোগ্যতা ও অভিযোজনযোগ্যতা প্রমাণ করে। একইসাথে পরিবেশের বিশুদ্ধতাও বজায় রাখে।
NTPC এর এক মুখপাত্র সরাসরি যা বলেছেন বা বাংলায় দাঁড়ায়:
“লেহ-এর মাটিতে সফল পরীক্ষা প্রমান করেছে যে হাইড্রোজেন শুধু ভবিষ্যতের বিকল্প জ্বালানিই নয়—এটি আজকের গণপরিবহনেও অত্যন্ত চরম পরিবেশে পরিচালিত হতে সক্ষম।”
উপসংহার
বিশ্বজুড়ে যখন জ্বালানি তেলের হাহাকার, আকাশ বাতাস দূষণে পরিপূর্ণ, সেই চরম সময়ে দাঁড়িয়ে এই পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন চালিত বাসগুলো তাদের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু করতে চলেছে; লাদাখ যে একটি নতুন পরিবহন ব্যবস্থার পথ দেখাচ্ছে তা আক্ষরিক অর্থে চরম সত্য তো বটেই, উপরন্তু বিশ্বের বাকি সব প্রথমসারির দেশগুলির পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব দেশ তথা বিকল্প জ্বালানির উৎস হিসাবে সমগ্র বিশ্বে একটি শক্তিশালী জায়গা স্থাপন করছে। এই প্রকল্পের সাফল্য আগামীতে অন্যান্য অঞ্চলেও “hydrogen-powered buses” জনপ্রিয়তা বাড়াতে সহায়ক হবে, এবং পাশাপাশি নির্মল ভারত গঠনের লক্ষ্য অর্জনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।